Worldwide Bengali Panjika

মা বিপত্তারিণী পূজা – Bipodtarini Puja


বিপত্তারিণী পূজা (Bipodtarini Puja): বিপত্তারিণী অর্থাৎ যে দেবী সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। সকল দেবদেবীর পূজা অর্চনা এবং ব্রত পালন মানুষকে মানসিক শান্তি দেওয়ার পাশাপাশি সকল বিপদ থেকে এবং সংসারের অমঙ্গল থেকে বাঁচাতে পারে। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া অর্থাৎ রথযাত্রা (Rath Yatra) এবং শুক্লা দশমী অর্থাৎ উল্টোরথ (Ulto Rath) বা রথের পুনার্যাত্রার মাঝে শনিবার ও মঙ্গলবারে এই বিপত্তারিণী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

এই পূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লাল সুতোর ডোরের সাথে ১৩/১৪ টি গিট দিয়ে তার মধ্যে দুর্বা ঘাস লাগানো, যা প্রতিটি বাচ্চা থেকে বড় সকলের বিশ্বাস ও ভরসা জড়িয়ে থাকে। গ্রাম বাংলার পাশাপাশি উড়িষ্যার আশেপাশের গ্রামে গঞ্জে বিপত্তারিণী পূজা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বিভিন্ন মন্দির এবং থানে এই বিপত্তারিণী ব্রত (Bipodtarini Vrat) পালন করা হয়। আর সেখানে বাড়ির মা ও বোনেরা উপবাস পালন করে এই ব্রত পালন করে থাকেন।

মা বিপত্তারিণী পূজা ব্রতকথা:

মা বিপত্তারিণীর ব্রতকথা (Maa Bipodtarini Vrat) কিন্তু দুটি রাজ পরিবারের কাহিনী কে ঘিরে গড়ে উঠেছে, তখন বিদর্ভের রাজা ছিলেন সত্যদাস । তাঁর পুত্র অলোকেশ একবার হরিণ শিকার করতে করতে পথ ভুলে পাশের রাজ্য অবন্তিপুরের সীমানায় ঢুকে পড়েন। সেই জায়গাটি ছিল অবন্তি রাজ্যের মৃগয়া ক্ষেত্র। সেখানে একটি হরিণ শিকার করলে অবন্তী রাজ্যের সেনারা তাঁকে বেঁধে নিয়ে যায় রাজ দরবারে। সেই সময় অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন চক্রধর, তিনি সমস্ত ঘটনা শোনার পর অলোকেশকে বন্দী করার আদেশ দিলেন।

রাজপুত্রের বন্দী হওয়ার খবর চলে যায় রাজপুত্রের পিতার কাছে, সত্যদাস ছুটে গেলেন অবন্তি রাজের দরবারে। কিন্তু অবন্তি রাজ তাঁকেও বন্দি করে রাখলেন। বিদর্ভ রাজ্যের রাজা এবং রাজপুত্রের বন্দী হওয়ার খবর পেয়ে বিদর্ভের রানী রত্না কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং তিনি চোখের জল মুছে পূজার আয়োজন করতে শুরু করেন। সেই দিনটি ছিল রথ যাত্রার পরের মঙ্গলবার, দেবী বিপত্তারিণীর পূজা সেরে রানী ভক্তি ভরে দেবীর স্তব করতে লাগলেন এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

সেই দেবী হলেন দেবী দুর্গার আর একটি রূপ। দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে রানী রত্না প্রার্থনা করতে লাগলেন আর সংকল্প করলেন মায়ের কৃপা না হলে তিনি এই দেহ ত্যাগ করবেন। একদিক থেকে স্ত্রী এবং অন্য দিক থেকে মায়ের এই কাতর প্রার্থনা শুনলেন দেবী। সেই রাতেই দেবী বিপত্তারিণী অবন্তিরাজ চক্রধরকে স্বপ্ন দিয়ে বললেন যে, “তুমি আমার ভক্তকে বন্দী করে রেখেছো দেখে আমি কষ্ট পাচ্ছি এখনই তাদের মুক্তি দাও”।

এই স্বপ্ন পেয়ে অবন্তিরাজ তখনই বিদর্ভরাজ সত্যদাস এবং তাঁর পুত্র অলোকেশকে মুক্তি দিলেন। সেই সঙ্গে নিজের মেয়ের সঙ্গে অলোকেশের বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। এভাবেই দুই রাজ্য আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ল, আর এভাবেই দেবীর প্রসাদ লাভ করে শান্তি ফিরলো উভয় রাজ্যে। এই বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন বিপদতারিনী/বিপত্তারিণী দেবী। বিদর্ভের রানী রত্নার এই ব্রতকথা স্মরণ করে আজও গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে মহিলারা সংসারের সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠতে এবং স্বামী ও সন্তানদের সুরক্ষা করতে, সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে, দেবী বিপত্তারিণীর পূজা করে থাকেন ভক্তি ও নিষ্ঠাভরে।

মা বিপত্তারিণীর রূপ:

দেব-দেবীদের রূপ দেখেই সেই দেব-দেবীকে চিহ্নিত করা হয় এবং তাকে সেই ভাবেই ডাকা হয়। বিপত্তারিণী আসলে দেবী দুর্গা বা কালির একটি রূপ। দুর্গার মতই তিনি হলেন সিংহ বাহিনী। তবে কোথাও তিনি রক্তবর্ণা আবার কোথাও তিনি কালীর মতো কৃষ্ণবর্ণা। তাঁর চারটি হাতে খড়গ রয়েছে, ত্রিশূল ও বরাভয় মুদ্রা রয়েছে। অনেক ভক্তগণ মনে করেন মা বিপত্তারিণী আসলে বাংলার একটি লৌকিক দেবী, তবে মার্কন্ডেয় মুনি প্রথম বিপত্তারিণী ব্রত কথা প্রচার করেন।

বিপত্তারিণী পূজার প্রয়োজনীয় উপকরণ:

  • তেরো রকমের ফুল,
  • তেরো রকমের ফল,
  • তেরোটি পান,
  • ১৩ টি সুপারি,
  • ১৩ গাছা লাল সুতোতে ১৩ টি দূর্বাঘাস সহযোগে ১৩ টি অথবা ১৪ টি গিট বেঁধে ডোর তৈরি করা,
  • শীষসহ ডাব,
  • আমের পল্লব,
  • পূজার জন্য ফুল,
  • ধুপ,
  • ধূনা,
  • শঙ্খ,
  • প্রদীপ,
  • পূজার থালা,
  • ভোগ অথবা নৈবেদ্য হিসেবে ১৩ টি লুচি,
  • ১৩ টি পৈতে,
  • ১৩ টি লবঙ্গ,
  • ১৩ টি ছোট এলাচ,
  • ১৩ টি বড় এলাচ,
  • পূজা শেষে পুরোহিতকে দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য দক্ষিণা ইত্যাদি।

বিপত্তারিণী পূজা বিধি:

১) এই পূজা মূলত মহিলারা রথযাত্রা ও পুনার্যাত্রার মাঝের শনিবার ও মঙ্গলবারে উপবাস থেকে দেবীর পূজা অর্চনায় অংশগ্রহণ করেন।

২) এই ব্রত পালনে মহিলাদের অবশ্যই আলতা এবং সিঁদুর পরা বাঞ্ছনীয়।

৩) এই ব্রত পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই পালন করতে পারবেন। তাছাড়া আমিষ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি এলকোহল এবং অন্যান্য নেশা জাতীয় জিনিস কিন্তু এড়িয়ে চলতে হবে।

৪) ব্রত পালনকারী ব্যক্তি ফল এবং জল খেতে পারেন, যাঁদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যা আছে তাঁদের ব্রত পালন এড়িয়ে চলা উচিত।

৫) মনস্কামনা পূর্ণ করতে হাতে লাল সুতোর ধাগা (ডোর) ধারণ করা হয় এবং সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে বলে এমনটাই বিশ্বাস করা হয়।

৬) সেই ধাগায় ১৩ টি দুর্বা ঘাস সহ ১৩ টি অথবা ১৪ টি গিফট দেওয়া হয়।

৭) সেই সঙ্গে ১৩ রকম ফল এবং তেরো রকম ফুল দিয়ে দেবীর পূজা-অর্চনা করা হয়।

৮) সন্ধ্যায় পূজা করার সাথে সাথে আরতিও করা হয়।

৯) অনেকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা পেতে এবং সংসারের মঙ্গল কামনা এবং মনস্কামনা পূর্ণ করতে দন্ডি কাটেন।

১০) দন্ডি কাটার ক্ষেত্রে স্থানীয় নদী বা কোন জলাশয়ে স্নান করে দন্ডী কেটে পুজোর স্থানে গিয়ে দেবীর পূজা করতে হয়।

বিপত্তারিণী ব্রত পালনের নিয়ম:

বিপত্তারিণী ব্রত পালন করলে আপনাকে যে বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হবে:

  • বিপত্তারিণী ব্রত পালন করার আগের দিন শুধুমাত্র নিরামিষ খাবার গ্রহণ করতে হয়।
  • ব্রত পালনের দিনে কোন খাবার খাওয়া যায় না, পুজোর পরে উপবাস ভাঙ্গা হয় পূজোর প্রসাদ খেয়ে।
  • সমস্ত রকমের বাধা বিপত্তি ও বিপদ থেকে সন্তান ও পরিবারের সকলকে রক্ষা করার জন্য এই পূজা করা হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • বিপত্তারিণী পূজার দিন চাল ও গমের কোন খাবার না খাওয়াই ভালো।
  • ব্রত পালনকারী ব্যক্তি হাতে ১৪ গিটের লাল সুতো বাঁধেন, মহিলারা বাম হাতে বাঁধেন এবং পুরুষরা ডান হাতে সেই সুতো বেঁধে থাকেন।
  • পুজো চলাকালীন সময়ে কারো সাথে কথা বলা যাবে না, অনুমান করা হয় যে এর ফলে দেবী খুবই রেগে যান এবং সংসারে অর্থ সম্পর্কিত সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তার সাথে সাথে ব্যবসা থাকলে ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে, তাছাড়া বাড়ির সদস্যদের অসুস্থতা আসতে পারে।
  • পূজার সময় কখনই কাউকে অপমান করা উচিত নয়, এমনকি এদিন কোন মহিলার সম্পর্কে কটুক্তি বা কুরুচিকর বাক্য ব্যবহার করা যাবে না এতে কিন্তু মা বিপত্তারিণী খুবই অসন্তুষ্ট হন।
  • কোন অপরিষ্কার, অন্ধকার বা অপরিচ্ছন্ন জায়গায় বিপত্তারিণী পূজা করা একেবারেই উচিত নয়, না হলে ঘরের সুখ ও শান্তি নষ্ট হয়ে যায়।
  • এই পূজার দিন কোন ব্যক্তিকে চিনি দেওয়া উচিত নয়, জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে চিনির শুক্র এবং চন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে শুক্র বস্তুগত সুখের কর্তা তাই এই দিন চিনি প্রদান করলে শুক্র দুর্বল হয় এবং সংসারে অশান্তির পাশাপাশি আর্থিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • বিপত্তারিণী পূজার আচার-আচরণে অর্থাৎ রীতিতে কোন কিছু ভুল হলে আর্থিক সমস্যা দেখা তো দেবেই তার ফলস্বরূপ ব্যবসায় ক্ষতির সম্ভাবনা তো থাকছেই।

✨ সাধারণত গ্রামাঞ্চলে বিপত্তারিণী পূজা চার দিন ধরে পালিত হয় এবং সেখানে প্রথম দিনে দেবীর আরাধনা করা হয় এবং মেয়েরা দন্ডি কেটে এখানে মানত পূরণ করেন। ব্রাহ্মণ, পুরোহিতরা আমের পল্লবসহ ঘট স্থাপন করেন। নাম, গোত্র সহযোগে পূজা দেন বাঙালি মেয়েরা। পূজোর পরে শোনা যায় বিপত্তারিণী ব্রতকথা যা এই পূজার অন্যতম একটি অংশবিশেষ। খুব ধুমধুম করে চলে এই পূজা উদযাপন। দুই রাত ধরে বাংলা লোকগান, ভজন ও কীর্তন অনুষ্ঠিত হয় আর চতুর্থ দিনে দেবীর নিরঞ্জন অর্থাৎ বিসর্জন হয়ে যায়।

বিপত্তারিণী পূজা উপলক্ষে মহিলাদের সাধারণত উপবাস করে থাকতে হয়। প্রথা অনুযায়ী তাঁরা হাতে এই লাল সুতো দুর্বাঘাস সহ পরিধান করেন যা কিনা বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিক হিসেবে মনে করা হয়। লাল সুতোর এই বিষয়টি বিপত্তারিণী পূজার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যদি কোন মহিলা অথবা পুরুষ যে কেউ এই ব্রত পালন করতে পারেন তবে একবার যদি এই ব্রত পালন করেন তাহলে কমপক্ষে তিন বছর পর পর উপবাস থেকে ব্রত পালন করার কথা বলা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!