পুষ্কর স্নান (Pushkar Snan): সনাতন ধর্মে পূণ্য স্নান, গঙ্গা স্নান, এসবের কথা তো অবশ্যই শুনেছেন, তবে এমন কিছু তীর্থক্ষেত্র রয়েছে যেখানে গেলে সেখানকার সেই পবিত্র হ্রদ অথবা পুষ্কর যাই বলুন না কেন, সেখানে যদি পূণ্য স্নান সম্পন্ন করতে না পারেন তাহলে সেই তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ হয় না বলে মনে করা হয়। তেমন একটি বিশেষ পবিত্র জায়গা হল ‘পুষ্কর’।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
পুষ্কর এমন একটি স্থান যেখানে ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে, এখানে ব্রহ্মার পূজা করা হয়, জয়পুরের দক্ষিণে অবস্থিত আজমির যেখানে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সংযোগস্থল বলা যায়। আজমির থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুষ্করের মন্দির ও হ্রদ হিন্দু ভক্তদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং একটি পবিত্র স্থান। আরাবলি পর্বতমালার নাগ পর্বত আজমির ও পুষ্কর কে পৃথক করেছে।
পুষ্কর শব্দের অর্থ:
পুষ্কর কথাটি এসেছে পুষ্করিনী অর্থাৎ পুকুর এই কথা থেকে। আর এর মধ্যে আরও একটি অর্থ হল যে পুকুর অথবা হ্রদ, যা ফুল দিয়ে নির্মিত। চারিদিকে পদ্মফুল ফুটে থাকবে। পদ্মপুরাণ অনুযায়ী পুষ্কর হ্রদ তখন নির্মিত হয়েছিল যখন যজ্ঞের স্থান সুনিশ্চিত করার পর ব্রহ্মার হাত থেকে পদ্মফুল পৃথিবীতে পড়ে যায়।
তিন ফোটা জল পৃথিবীতে পড়ে এর মধ্যে এক ফোঁটা জল গিয়ে পড়ে পুষ্করে এবং সেখানে হ্রদের নির্মাণ হয়। সেই কারণেই তো পুষ্কর হ্রদ এত বেশি পবিত্র আর এখানে স্নান করলে পূণ্য অর্জন করার পাশাপাশি আপনার পাপও ধুয়ে যায়।
পুষ্কর স্নান হলো পবিত্র স্থান:
সারাবিশ্বে শুধুমাত্র রাজস্থানের পুষ্করে ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে। এই স্থানটি আবার ব্রহ্মার নিবাসস্থল হিসেবেও সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়। মন্দিরের পাশে অবস্থিত পুষ্কর হ্রদ কার্তিক মাসে প্রচুর সংখ্যক তীর্থযাত্রীরা এখানে পূর্ণ স্নান করতে এবং ব্রহ্মার মন্দিরে প্রদক্ষিণ করতে অথবা পূজাতে চলে আসেন। এই হ্রদে ডুব দিয়ে পূণ্য অর্জন করাই হলো এই ভক্তদের মূল উদ্দেশ্য।
পুষ্কর নিয়ে পৌরাণিক কাহিনী:
প্রতিটি পূজা পার্বণের যেমন পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে তেমনি পুষ্কর স্নান নিয়েও রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার কাজ জন্ম দেওয়া বা সৃষ্টি করা, চার মাথাযুক্ত ব্রহ্মার প্রতিটি হাতে বেদরূপী জ্ঞান বিরাজ করে।
হাঁস হল ব্রহ্মার বাহন, একসময় ব্রহ্মা পবিত্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন। সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শুভ সময়ে স্বস্ত্রীক এই যজ্ঞ করার ইচ্ছা ছিল ব্রহ্মার। কিন্তু ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী তাকে অপেক্ষা করতে বলেন, তাই রেগে গিয়ে গোয়াল বালিকা রুপি গায়ত্রীকে বিবাহ করে তার সঙ্গে যজ্ঞ তে অংশগ্রহণ করেন ব্রহ্মা।
পরে যখন সরস্বতী ফিরে এসে নিজের স্থানে পরস্ত্রীকে বসে থাকতে দেখেন তখন ভীষণভাবে রেগে যান তিনি। তারপরই তিনি ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে, পৃথিবীবাসী তাকে ভুলে যাবেন এবং কখনো তার পূজা করবেন না। কিন্তু অন্যান্য দেবতাদের প্রার্থনায় মন গলে সরস্বতীর এবং তিনি জানান যে, শুধুমাত্র পুষ্কর এ ব্রহ্মা পূজিত হবেন। এই কারণে পুষ্কর ছাড়া অন্য কোথাও ব্রহ্মার পূজা করা হয় না।
পুষ্কর স্নান নিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস:
প্রতিটি পূজা পার্বণের পিছনে থাকে কোন না কোন কাহিনী এবং কারণ, আর সেই হিসেবেই কিন্তু সকল ভক্তগণ সেই ব্রত পালন করে থাকেন অথবা পূজা করে থাকেন। ধর্মীয় বিশ্বাস তো অবশ্যই থাকে, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য পুষ্কর হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তীর্থস্থান। মনে করা হয় প্রতিটি ব্যক্তিকে অন্তত জীবনে একবার হলেও পুষ্করে আসা উচিত।
তাছাড়া বেনারস ও প্রয়াগের মতো সমান গুরুত্ব বহন করে এই বিশেষ তীর্থস্থানটি। জগন্নাথ, বদ্রিনারায়ণ, দ্বারকা, রামেশ্বরম কে একত্রে ‘চারধাম’ বলা হয়। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, চার ধামের যাত্রা করার পর পুষ্কর হ্রদে স্নান না করা পর্যন্ত এই তীর্থযাত্রা কোন ভাবেই কিন্তু আপনি সম্পূর্ণ করতে পারবেন না। আর এর পূণ্য ফল লাভ করাও সম্ভব নয়। তাই তীর্থযাত্রাতে গেলে অবশ্যই এই পুষ্কর স্নান আপনাকে করতেই হবে।
পুষ্করে ব্রহ্মার মন্দির:
এখানে ব্রহ্মার যে মন্দিরটি আপনি দেখতে পাবেন সেটি মার্বেল পাথরে নির্মিত। রুপোর কয়েন দিয়ে সাজানো হয়েছে এই মন্দির। এখানে একটি রজত কচ্ছপও রয়েছে। আবার গায়ত্রী দেবীর ছোট একটি মূর্তিও লক্ষ্য করা যায়। এখানে ব্রহ্মার মূর্তির পাশাপাশি শিবকে নিবেদিত একটি গুহা রয়েছে।
পুষ্কর হ্রদে স্নান করার তাৎপর্য:
পুষ্কর হ্রদ শুধু একটি ঐতিহাসিক তীর্থক্ষেত্র নয় এটি একটি আধ্যাত্মিক স্থানও বটে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এই হ্রদের জলে স্নান করা একজনের পাপ ধুয়ে ফেলতে পারে এবং পরিত্রাণ প্রদান করতে পারে।
এর সাথে সাথে বলা হয়েছে এই হ্রদে ডুব দিলে বিভিন্ন ধরনের রোগও সেরে যায় এবং যাঁদের ত্বকের সমস্যা রয়েছে তাও সেরে যায়, এমনটা বিশ্বাস করেন সকলে। অনেক ভক্তও হ্রদ প্রদক্ষিণ করেন এবং বিভিন্ন দেবদেবীর কাছ থেকে আশীর্বাদ পেতে এর আশেপাশের মন্দিরগুলি এবং ঘাট পরিদর্শন করতে ভোলেন না।
পুষ্কর মেলা:
এখানে সংস্কৃতিক মেলার অনুষ্ঠান হয় যা সকল দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সারা ভারত এবং বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এই উৎসবে অংশ নিতে পুষ্কর হ্রদে আসেন। যেখানে উটের দৌড়, লোকনৃত্য, সংগীত প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য সংস্কৃতি ক্রিয়া-কলাপ দেখতে পাওয়া যায়।
মেলাটি ভগবান ব্রহ্মার জন্মদিনের সাথেও মিলে যায়। যা উপলক্ষে ধর্মীয় উৎসাহকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এছাড়া এখানে ক্যাম্পিং, হট এয়ার বেলুনিং, কোয়াড বাইকিং আরো অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কার্যক্রম আপনি উপভোগ করতে পারবেন।
তার সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের দোকানও বসে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়, এখানে কেনাকাটাও করা যেতে পারে আপনার পছন্দের এবং এমন কিছু ইউনিক জিনিসও এখানে খুঁজে পেতে পারেন।
পুষ্কর হ্রদ একটি প্রাকৃতিক বিষয় এবং প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকরা এখানে আসেন আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য দর্শন করার জন্য। রাজস্থানের আজমির জেলায় অবস্থিত এই হ্রদটি ৫০০ টিরও বেশি মন্দির এবং ৫২ টি ঘাট দ্বারা বেষ্টিত। তবে পুষ্কর হ্রদ শুধুমাত্র উপাসনার স্থানই নয়, এটি সৌন্দর্য সংস্কৃতি এবং অ্যাডভেঞ্চারের একটি বিশেষ স্থানও বটে।
পূণ্য অর্জন করার জন্য অনেক কষ্টই তো করতে হয় সকল ভক্তগণকে। তবে এই জীবনে একবার হলেও এই পুষ্কর হ্রদে স্নান করলে জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট মুছে গিয়ে সংসার জীবনে যেমন সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বিরাজ করে তেমনি মৃত্যুর পরে মোক্ষ লাভ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তীর্থযাত্রাতে গেলে সেই তীর্থযাত্রার পূণ্য ফল আপনি সম্পূর্ণরূপে পাবেন। সারা বিশ্বে শুধুমাত্র এই পুষ্করেই রয়েছে ব্রহ্মার মন্দির, তাই জীবন যদি একবার এখানে যাওয়া যেতে পারে তাহলে সেটাকে ভক্তগণ খুবই পূণ্য ও ভক্তির কাজ বলে মনে তো করবেনই, তাই না !