Worldwide Bengali Panjika

যমদীপ দান পূজা ও প্রথা – Yamdeep Daan Puja


যমদীপ দান প্রথা: হিন্দু ধর্মে এমন একটি উৎসব রয়েছে যার সাথে এই উৎসবের সম্পর্ক রয়েছে একেবারে কাছের। ধনতেরাসের নাম শোনেননি এমন হিন্দু খুবই কম রয়েছেন। এই উৎসব উপলক্ষে অনেকেই নিজেদের পছন্দের জিনিসপত্র কেনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন সারা বছর।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

ধনতেরাস থেকে দীপাবলি উৎসব শুরু হয়, ধনতেরাসের সন্ধ্যায় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে ভগবান কুবেরের পূজা করা হয় আর এই সময়ে মৃত্যুর দেবতা যমরাজকেও পূজা করা হয়। তার সাথে সাথে সন্ধ্যায় দক্ষিণ দিকে যম প্রদীপ জ্বালানো হয়। এক কথায় এই দিনে এই প্রথা যমদীপদান হিসেবে সকলেই জানেন। যম প্রদীপের পৌরাণিক গুরুত্ব এবং শুভ সময় সম্পর্কে অনেকেই হয়তো অবগত রয়েছেন আবার অনেকেই জানেন না।

যমরাজের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো হয় কেন?

ধনতেরাস যেমন সমৃদ্ধির উৎসব তেমনি মৃত্যুর দেবতা যমরাজকে সন্তুষ্ট করতে এই দিন প্রদীপ দান করা হয়। দেবী লক্ষ্মী এবং ভগবান কুবেরের পূজোর পাশাপাশি যমরাজকে সন্তুষ্ট করতে পূজা করা হয় এবং বাড়ির দক্ষিণ দিকে চার মুখী প্রদীপ জ্বালানো হয়। শাস্ত্র অনুসারে বাড়ির দক্ষিণ দিকের অধিপতি হলেন যমরাজ

পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে ধনতেরাসে দক্ষিণ দিকে যমের প্রদীপ জ্বালালে যমরাজ খুবই প্রসন্ন হন এবং সেই গৃহস্থের বাড়িতে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি থাকে আর বাড়ির সকল সদস্যের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তবে সন্ধ্যার সময় এই প্রদীপ জ্বালানো হয় বলে এর শুভ সময় হিসাবে বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এই প্রদীপ জ্বালানোর একটা শুভ সময় রয়েছে। এর মধ্যেই এই যম প্রদীপ জ্বালাতে হয়।

পৌরাণিক কাহিনী:

একসময় যমরাজ নিজের দূতদের জিজ্ঞেস করেন যে কোন জীবের প্রাণ হরণ করার সময় তাদের কারো উপর কি দয়া আসে না ? প্রথমে সংকোচ করলেও যমযুতরা পরে জানায় যে, তাদের কোন দয়া হয় না, কিন্তু দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করায় একটি ঘটনা সম্পর্কে যমরাজকে বলেন। হেম নামক রাজার স্ত্রী এক সুন্দর পুত্র জন্ম দিয়েছেন, পুত্র সন্তানের জন্মের পর জ্যোতিষীরা নক্ষত্র গণনা করে জানান বিবাহের চারদিন পর সেই বালকের মৃত্যু হবে।

এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পরে রাজা সেই বালককে যমুনা নদীর তীরে একটি গুহায় ব্রহ্মচারী হিসেবে লালন পালন করতে শুরু করেন। একদিন সেই যমুনা তীরে মহারাজা হংসের পূত্রী অর্থাৎ রাজকন্যা ঘোরাফেরা করছিলেন। রাজকুমার সেই রাজকুমারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান এবং তারা গন্ধর্ব মতে বিবাহ করে নেন। অন্যদিকে জ্যোতিষ গণনা অনুযায়ী বিয়ের চার দিন পর রাজকুমারের মৃত্যু হয় স্বামীর মৃত্যু দেখে কান্না করতে থাকে রাজকুমারী। যমরাজকে বলেন মহারাজ সেই নববিবাহিতার বিলাপ শুনে আমাদের হৃদয় কেঁদে উঠেছে।

ওই রাজকুমারের প্রাণ হরণের সময় আমাদের চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পড়ে। আমাদের কান্না থামছিল না। তখন একজন দূত যমরাজ কে জিজ্ঞেস করেন যে অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচার কি কোন উপায় নেই প্রভূ ? এরপর যমরাজ তাদের একটি উপায় জানান, বলেন অকাল মৃত্যু থেকে যদি মুক্তি পেতে চায় মর্ত্যবাসি তাহলে নরক চতুর্দশীর দিনে নিয়ম মেনে পুজো ও প্রদীপ দান করতে হবে। তাহলে আর অকাল মৃত্যুর ভয় থাকে না, এই কারণে নরক চতুর্দশীর দিনে যম দেবতার নামে প্রদীপ দানের প্রথা প্রচলিত রয়েছে।

কিভাবে যম প্রদীপ জ্বালাতে হবে?

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক যমদীপ দান করার জন্য আপনাকে কিভাবে যম প্রদীপ জ্বালাতে হবে?

  • ধনতেরাসের দিন আটা দিয়ে তৈরি করা চার মুখী প্রদীপ তাতে সরিষার তেল দিয়ে বাতি দিতে হবে, যা তুলো দিয়ে তৈরি করা হয় এবং সেই প্রদীপের চারটি বাতি রেখে বাড়ির দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রদীপ জ্বালাতে হবে।
  • এছাড়া বাড়ির মূল প্রবেশদ্বারে গরুর দুধের ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালালে দেবী লক্ষ্মীও খুশি হন এবং প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন তিনি।
  • যেহেতু এই উৎসব কালী পূজার কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয় সেই কারণে দীপাবলীর অনুষ্ঠান ৫ দিন ধরে পালিত হয় তার মধ্যে কৃষ্ণপক্ষে ত্রয়োদশী তিথিতে উদযাপিত হয় ধনতেরাস অথবা ধন ত্রয়োদশী পার্বণ।
  • তবে যমের প্রদীপ কখনোই বাড়ির ভিতরে জ্বালাবেন না, তাহলে জীবনে বাধা বিঘ্ন নেমে আসতে পারে।
  • এছাড়া পরিবারের সকল সদস্য বাড়িতে ফিরে আসার পরেই বাড়ির বাইরে দক্ষিণ কোণে জ্বালিয়ে দিতে হবে এই যম প্রদীপ। কারণ এই প্রদীপ জ্বালানোর পর কারোর বাড়ি থেকে বাইরে বার হওয়া নিষিদ্ধ বলে জানা যায়।
  • নিয়ম অনুসারে আপনি মাটির তৈরি প্রদীপ ও নিতে পারেন। যেখানে চারটি বাতি দেওয়া যায়।
  • প্রথমে প্রদীপটি জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। তারপর প্রদীপে বাতি দিয়ে দুটি ক্রস করে এমন ভাবে রাখুন যাতে প্রদীপের বাইরে চারটি দিক দিয়ে প্রদীপটি জ্বালানো যায়।
  • এভাবে প্রদীপ টি তিলের তেল দিয়ে জ্বালাতে পারেন এবং সেই তেলে কিছুটা কালো তিল দিয়ে দিতে পারেন।
  • এরপর হাতে ফুল নিয়ে যমদেবকে স্মরণ করে অভিবাদন করুন, “নম যম দেবায় নম” এই মন্ত্র উচ্চারণ করার মধ্যে দিয়ে।

যম প্রদীপ দান করার তাৎপর্য এবং ঘটনা:

যম প্রদীপ দান করলে সংসারের সকল সদস্যের স্বাস্থ্য বজায় থাকে, সংসারে সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি থাকে এবং সকলে অকাল মৃত্যুর থেকে মুক্তি পায়। এই যম প্রদীপ দান করার জন্য অকাল মৃত্যু যে রুখে যায় সেটার একটি পৌরাণিক ঘটনা থেকে জানা যায়। ভবিষ্যৎ বাণী হিসেবে জানা যায় যে এক রাজকুমারের বিবাহের পরে মৃত্যু ঘটবে তবে এই ভবিষ্যৎবাণী নববিবাহিতা স্ত্রী জানতে পেরে সারারাত সেই স্বামীকে ঘুমাতে দেননি এবং নিজের সমস্ত মূল্যবান অলংকার গুলো গেটের বাইরে একটি ডালিতে সাজিয়ে রাখেন। তার চারপাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলেন এবং সারাক্ষণ গান গাইতে থাকলেন যেন তার স্বামী ঘুমিয়ে না পড়েন।

সেই রাতে যখন মৃত্যুর দেবতা যম সাপ রূপে আসেন কিন্তু জ্বালানো প্রদীপের আলো ও অলংকারের ছটায় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তখন আর যমরাজ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন না। তখন সাপ রুপি ওই যম দেবতা ওই ডালিতে সাজানো অলংকারের উপর বিরাজমান হন। আর বিবাহিতার এই অভ্যর্থনা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে রাজকুমারকে জীবন দান দেন। এই জন্য আমাদের দীর্ঘায়ু ও যমরাজকে সন্তুষ্টির জন্য ধনতেরাসের দিন যমপ্রদীপ জ্বালানোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!