উত্থান দ্বাদশী ব্রত (Utthan Dwadashi Vrat): প্রতিদিন কোন না কোন পূজা – পার্বণ এর মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জীবনযাত্রা। একাদশী, দ্বাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন ধরনের ব্রত পালন, উপবাস পালন আর অনেক পূজা পার্বণও প্রতিনিয়ত হতে থাকে।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
এক একটি শুভ সময় ও শুভক্ষণে এই পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠিত হয়। তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রত হল উত্থান দ্বাদশী ব্রত (Utthan Dwadashi Vrat)। ভগবান বিষ্ণু শয়ন, পার্শ্ব পরিবর্তন এবং উত্থান উপলক্ষে আষাঢ় মাস, ভাদ্র মাস এবং কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে যে একাদশী পড়ে, তা বিশেষ শুভ ফল লাভ করার জন্য গণ্য করা হয়।
প্রত্যেক বছর পবিত্র এই কার্তিক মাস অথবা যাকে দামোদর মাস বলা হয় সেক্ষেত্রে এই মাসে শুক্লপক্ষে এই উত্থান দ্বাদশী অর্থাৎ উত্থান একাদশী তিথিতে ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। এই একাদশী নানা দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অনেক পৌরাণিক ব্যাখ্যা এবং তাৎপর্য রয়েছে।
উত্থান দ্বাদশী ব্রত:
স্কন্দ পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা নারদ এর সমন্বয়ে এই উত্থান দ্বাদশী বা এই উত্থান একাদশী সম্পূর্ণ বর্ণনা করা হয়েছে। যে সমস্ত ভক্তরা এই ব্রত পালন করবেন তাঁদের একাদশী ব্রত পালনের সময় এই ব্রতকথা তথা ব্রত মাহাত্ম্য পাঠ করা অথবা শ্রবণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উত্থান দ্বাদশী ব্রত কথা:
একদিন মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি ? আর সেই একাদশীর গুরুত্ব কতখানি ? এই ক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে, “হে রাজন, কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীর নাম উত্থান তথা প্রবোধিনী একাদশী। তবে এর সাথে দ্বাদশী ব্রত একসাথে পালন করা যেতে পারে। প্রজাপতি ব্রহ্মা পূর্বে নারদের কাছে এই একাদশী সম্পর্কে বর্ণনা করেছিলেন। তখন তুমি আমার কাছে সেই কথা শুনেছিলে।” এই বলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই উত্থান একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য সম্পর্কে যুধিষ্ঠিরের কাছে সমস্ত কিছু ব্যক্ত করতে শুরু করেন।
অন্যদিকে প্রজাপতি ব্রহ্মা নারদ এর কাছে ব্যক্ত করেছেন এই উত্থান একাদশী ব্রত সম্পর্কে। তিনি বলেন যে, “হে নারদ, উত্থান একাদশী যথার্থ পাপনাশিনী, মুক্তিপ্রদায়ী এবং পূণ্যবর্ধিনী। এই ব্রত নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং শত শত রাশি ও যজ্ঞের ফল অনায়াসে লাভ করা যায়। জগতের দুর্লভ বস্তুর প্রার্থী হয় এই একাদশী পালনের মাধ্যমে। এছাড়া মানুষকে রাজ্য, ঐশ্বর্য ও সুখ প্রদান করে। এই ব্রত পালনের প্রভাবে পর্বত সমান পাপ রাশিও বিনষ্ট হয়ে যায় এবং একাদশীর দিন রাত জাগার কারণে তাঁদের সমস্ত কিছু পূণ্য ফলে পরিণত হয়।
উত্থান দ্বাদশী ব্রত পালনের নিয়ম:
১) যে ভক্ত এই ব্রত পালন করবেন তিনি দশমীতে একবার খাবার গ্রহণ করবেন এবং একাদশীতে উপবাস পালন করবেন, তার পাশাপাশি দ্বাদশী তিথিতে একবার খাবার গ্রহণ করবেন। যদি সম্পূর্ণ উপবাস পালন করতে না পারেন তাহলে কেবলমাত্র একাদশীতে উপবাস পালন করতে পারেন।
২) আর যদি সেই উপবাসটাও পালন করতে সক্ষম না হয়ে থাকেন তাহলে একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করে ফল মূল এগুলি খেয়ে আপনি এই ব্রত পালন করতে পারবেন।
৩) একাদশী পালনের ক্ষেত্রে যে পাঁচ প্রকার রবিশস্য বর্জনের কথা বলা হয়েছে তা হলো চাল, গম, যব, ডাল ও সরিষা বা সরিষা থেকে তৈরি যে কোন খাবার সেটা সরিষার তেলও হতে পারে।
৪) এই দিন যিনি এই ব্রত পালন করবেন সে ক্ষেত্রে চা, কফি, পান, বিড়ি, সিগারেট যা কিছু নেশা জাতীয় দ্রব্য রয়েছে সেগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫) যে সমস্ত ভক্তগণ এই ব্রত পালন করবেন তাঁদের আগের দিন রাত বারোটার আগে অন্ন ভোজন করে নেওয়া খুবই জরুরী।
৬) একাদশীর দিন ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমে সংকল্প গ্রহণ করতে হবে, অবশ্যই স্নান সেরে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করার পরে।
উত্থান দ্বাদশী ব্রত পালনের বিষয়:
ব্রত পালনের সময় যে বিষয়ের উপরে খেয়াল দিতে হবে:
- এই ব্রত পালন করলে কেবলমাত্র উপবাস করে থাকাই নয়, তার সাথে নিরন্তর শ্রী ভগবানকে স্মরণ করা এবং ব্রতকথা পাঠ করা অথবা শ্রবণ করা তার সাথে সাথে কীর্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করা কিন্তু খুবই শুভ কাজ।
- এই দিন পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্যা কথা বলা, রাগ করা, দুরাচারিতা, স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রয়েছে।
- বিভিন্ন ছোট ছোট কাজকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন ধরুন:- সবজি কাটার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনভাবে হাত কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ না হয়, যদি রক্তক্ষরণ হয় তাহলে এই ব্রত পালন করার ক্ষেত্রে অশুভ বলে গণ্য করা হয়।
- এর ব্রত পালন করার দিন শরীরে প্রসাধনীর ব্যবহার করা নিষিদ্ধ অর্থাৎ তেল, কোন সুগন্ধি, শ্যাম্পু, সাবান এগুলি বর্জন করতে হবে এছাড়া কোনো রকম চুল, দাড়ি, নখ কাটা যাবে না।
- একাদশীর দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সন্ধ্যার সময় শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিবেদন করা।
- একাদশীর পরদিন অর্থাৎ দ্বাদশীর দিন একাদশীর পারণ ক্রিয়া সমাপ্ত করতে হয় এই পারণ ক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মন্ত্র উচ্চারণ করে সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে।
উপবাস থাকার কারণে শরীর যেমন সুস্থ সবল থাকে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের শরীরে সৃষ্টি হয়, তার পাশাপাশি ঈশ্বরের আশীর্বাদে সংসারে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বজায় থাকে এবং সৌভাগ্য ফিরে আসে। আরো অন্যান্য একাদশী ব্রত পালনের পাশাপাশি উত্থান দ্বাদশী অথবা একাদশী ব্রত পালনে আপনি জীবনে অনেকখানি পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন। সম্পূর্ণ সাধারণ জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে মনে কোন হিংসা, পাপ না রেখে যদি নিষ্ঠা ও ভক্তি ভরে ঈশ্বরের সেবায় নিযুক্ত থাকেন তাহলে আপনার জীবন সুন্দর থাকার পাশাপাশি শ্রী বিষ্ণুর চরণে স্থান পাবেন আর মোক্ষ লাভ করতে পারবেন।