কার্তিক ব্রত – Kartik Vrat (দামোদর মাসের ব্রত) পালনের নিয়ম: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সারা বছর ধরে কোন না কোন ব্রত, উপবাস, উৎসব এবং পূজা লেগেই রয়েছে। তাইতো বলা হয় বারো মাসে তেরো পার্বণ, তবে এর মধ্যে এমন অনেক ব্রত রয়েছে যা খুবই নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে পালন করতে হয়, আর তার সাথে কিছু কঠোর নিয়ম রয়েছে সেগুলিও পালন করতে হয়। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হল কার্তিক মাসের ব্রত পালন যা দামোদর মাসের ব্রত পালন হিসেবে অনেকে চেনেন।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে বাংলার বারো মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস কার্তিক মাসকে মনে করা হয়। কার্তিক মাসকে পুরুষোত্তম মাসও বলা হয়ে থাকে। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এটা মনে করা হয় যে, এই মাসে ধন-সম্পদ, সুখ, শান্তি পাওয়ার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মাস, তা ছাড়া দান করার জন্য এই মাস সর্বশ্রেষ্ঠ। সেই কারণে এই মাসে ব্রত পালন করে ঈশ্বরের কাছে সকল মনের ইচ্ছা জানানো হয়। এই মাসে দান করলে তা খুবই শুভ ফলদায়ক হয় বলে জানা যায়। এই মাসে লক্ষ্মী দেবীকে যদি সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে সারা বছর তাঁর কৃপায় সংসারে সমৃদ্ধি বজায় থাকে।
দামোদর মাসের ব্রত (কার্তিক ব্রত) পালনের কিছু নিয়ম:
এই মাসে পূর্ণিমাতে কার্তিক নক্ষত্রটি চাঁদের খুবই সহচর্যে থাকে বলে এই মাসের নাম কার্তিক, এদিকে শিবের পুত্রের নামও কিন্তু কার্তিক, তাই এই ব্রত নিয়ে নিষ্ঠা সহকারে কয়েকটি বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবাদিদেব মহাদেব ও গৌরী দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন সহজেই। তাই সম্পূর্ণ কার্তিক মাস জুড়ে মেনে চলুন এমন কিছু সাধারণ নিয়ম যেগুলি মেনে চললে ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি বজায় থাকবে আপনার এবং আপনার পরিবারের সকল সদস্যের উপর।
পদ্মপুরাণে ব্রহ্ম নারদ সংবাদে যা বলা হয়েছে:
- কার্তিক মাসে বরবটি ও শিম সমূহ ভক্ষণ করলে এক হাজার চতুরযুগ নরক বাসি হওয়ায় কথা উল্লেখ রয়েছে।
- কার্তিক মাসে যদি কোন ব্যক্তি কলমি শাক, বেগুন, পটল, আচার অথবা চাটনি ত্যাগ না করে তাহলে তাঁকে এক হাজার চতুরযুগ নরকবাসী হতে হবে।
- পরান্ন, পরশয্যা, পরধন, পর স্ত্রী, কার্তিককে প্রাজ্ঞ ব্যাক্তি বিশেষভাবে বর্জন করতে হবে।
- ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি কার্তিক মাস জুড়ে নিরামিষ খাবার গ্রহণ করবেন অর্থাৎ মাছ-মাংস ভক্ষণ করবেন না।
- কার্তিক মাসে তেল মালিশ করা, কাঁসার পাত্রে খাবার খাওয়া, সুন্দর বিছানা এগুলি ত্যাগ করতে পারলে পরিপূর্ণ ব্রতী হয়ে ওঠা যায় এই কার্তিক ব্রত পালনে।
কার্তিক মাস অথবা দামোদর মাসের মাহাত্ম্য:
এই মাসটিকে জপ, তপ, ব্রত সাধনার মাস বলে মনে করা হয়। এই মাসে ঈশ্বরের ভক্তি ও পূজা অর্চনা করলে সমস্ত মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। পুরান অনুযায়ী বিষ্ণু এই মাসে নারায়ণ রূপে জলে বাস করেন। এই কারণে কার্তিক কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথি থেকে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে নদী অথবা পবিত্র জলাশয়ে স্নান করে অক্ষয় পূণ্য লাভ করা যায়।
শাস্ত্র অনুযায়ী যে ব্যক্তি কার্তিক মাসে প্রতিদিন গীতা পাঠ করে থাকেন তাঁরা অনন্ত পূণ্য অর্জন করে থাকেন। এই মাসে গীতার একটি অধ্যায় পাঠ করলে সেই ব্যক্তি ঘোর নরক থেকেও মুক্তি লাভ করে বলে জানা যায়। এছাড়া এই কার্তিক মাসে অন্ন দান করলে জেনে না জেনে করা পাপও নাশ হয়।
কার্তিক ব্রত পালন করার কিছু নিয়ম:
১) কার্তিক মাসের সূর্য উদয়ের আগে উঠতে হবে, নদীতে স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় এবং মোক্ষ লাভের পথ প্রশস্ত হয়।
২) এই মাস জুড়ে তুলসী পূজোর বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। সেই কারণে প্রতিদিন তুলসী গাছের পুজো করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত এবং তুলসী গাছের পরিক্রমা করতে হবে।
৩) এই মাসে অন্ন, উলের পোশাক, প্রদীপ, তিল, আমলকি, এগুলি দান করা অত্যন্ত শুভ। এই উপায় অবলম্বন করে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ লাভ করা যায়।
৪) কার্তিক মাসে বিষ্ণুর স্বরূপ শাল গ্রামের পুজো করলে বিশেষ ফল ভোগ করতে পারেন সেই ভক্ত।
৫) কার্তিক মাস জুড়ে প্রতিদিন গীতা পাঠ, মন্দির, নদী, তীর্থস্থানে প্রদীপ জ্বালানো খুবই শুভ ফলদায়ক যা আপনার জীবনের সমস্ত বাধা বিপদ কাটিয়ে তুলতে পারে।
৬) সুন্দর নরম বিছানা ত্যাগ করে কার্তিক মাসে যদি সারা মাস জুড়ে মেঝেতে ঘুমানো যায় তা খুবই শুভ ফলদায়ক।
৭) শাস্ত্র অনুসারে জানা যায় এই মাসে সূর্য এবং চাঁদের রশ্মি মন এবং শরীরের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাই এই মাসে যে কোন ব্রত পালন করলে মনের ইচ্ছা ও শুভফল লাভ করা যায়।
৮) আপনি যদি ভগবান বিষ্ণু এবং দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেতে চান তাহলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয়ের আগে তুলসীকে জল দিন, এর ফলে সব ধরনের রোগ দূর হয়ে যায়।
কার্তিক মাসে ব্রত পালনে যে কাজগুলি করবেন না:
- আমরা আগেই জেনেছি কার্তিক মাসে বিষ্ণু জলে বাস করেন আর সেই জন্য এই মাসে ভুলেও কিন্তু মাছ অথবা অন্যান্য আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা, যদি আপনি এই ব্রত নিষ্ঠা ভরে পালন করতে চান তো।
- এছাড়াও বিউলির ডাল, মুগ ডাল, মসুর ডাল, ছোলা, মটর, গোটা সরষে এগুলি খাওয়া নিষিদ্ধ।
- এই মাসে শরীর মন সংযত রেখে জীবন যাপন করতে হয়।
- সমগ্র কার্তিক মাসে দুপুরবেলা ঘুমাতে নেই।
- এই মাসে শরীরে তেল লাগানো উচিত নয়, শুধুমাত্র নরক চতুর্দশীর দিনে শরীরে তেল লাগানো যেতে পারে।
কার্তিক ব্রত পালনের তাৎপর্য:
প্রতিটি ব্রত পালনের পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী এবং তার তাৎপর্য। সেই অনুসারে মানব শরীরেও অনেকখানি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কথিত আছে যে, কার্তিক পূর্ণিমায় ভগবান বিষ্ণু মৎস্য অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
কার্তিক পূর্ণিমার সময় চাঁদ তার পূর্ণ শক্তিতে বিরাজমান থাকে সেই কারণে পাপ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের বাধা গুলি দূর করার জন্য আর সংসারের সুখ শান্তি সমৃদ্ধি বজায় রাখতে কার্তিক মাসের এই ব্রত পালন করতে পারেন। যে বিধি নিষেধ গুলো রয়েছে সেগুলিও মেনে চললে আর নিষ্ঠা ভরে ব্রত পালন করলে, এর ফলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আপনার এবং আপনার পরিবারের উপরে বর্ষিত হবে এবং আপনিও শুভ ফল লাভ করতে পারবেন।