Worldwide Bengali Panjika

টুসু পূজা ও টুসু উৎসবের জানা-অজানা কথা


টুসু পূজা (Tusu Puja): নানা রকমের উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করতে কার না ভালো লাগে, তবে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উৎসব উদযাপন করা হয়। আর সেই উৎসবকে ঘিরে স্থানীয় মানুষজন ভীষণভাবে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। তেমনই একটি লোকউৎসব হলো টুসু পূজা অথবা টুসু উৎসব, অনেকেই “মকর পরব” নামে জেনে থাকবেন। এই উৎসবটি অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে শুরু হয় আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তি অথবা মকর সংক্রান্তির পূণ্য লগ্নে।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

টুসু পূজা (Tusu Puja) অথবা টুসু উৎসব (Tusu Utsav) একটি লৌকিক দেবী যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় এবং প্রধানত কুমারী মেয়েরা টুসু পূজার প্রধান ব্রতী হয়ে থাকেন, উদ্যোগী হয়ে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই পূজা ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

এই উৎসবটি কৃষিভিত্তিক একটি উৎসব হিসেবেই অনেকেই মনে করেন। টুসুপূজা যাকে টুসু উৎসব বলা হয়, এই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীন এলাকায় এবং আসামের চা উপজাতিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব। এটি দেবী টুসুর উপাসনা জড়িত একটি প্রচুর ফসল কাটার রীতি উদযাপন প্রথা বলা যায়।

গ্রাম বাংলার লোকউৎসব টুসু উৎসব:

গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়িতে এবং বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই ব্রত এবং পূজা উৎসব খুবই ভালোভাবে পালন করে থাকেন। সেখানে দূর দূরান্তr থেকে মানুষ এসে ভিড় জমান এই পূজা উপলক্ষে।

ভীষণ বড় মেলা বসে এবং সেই মেলাতে অংশগ্রহণ করেন আশেপাশের মানুষ থেকে দূর থেকে আগত দর্শনার্থীরা। এই মেলাতে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়ে থাকে যা স্থানীয় মানুষদের আনন্দ উৎসবের এক উৎস বলা যায়।

টুসু দেবীর মূর্তি:

অধিকাংশ জায়গায় পুরাতন প্রথা অনুযায়ী টুসু উৎসবে কোন মূর্তির স্থান নেই অথবা প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এবং বাঁকুড়া জেলার খাতরা থানায় আরো কিছু এলাকায় টুসু মূর্তির প্রচলন রয়েছে।

বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘোড়ার উপরে অথবা ময়ূরের উপরে সুন্দরী নারী মূর্তি গুলির গায়ের রং হলুদ বর্ণের এবং শাড়ি নীল রংয়ের হয়ে থাকে, মূর্তির হাতে থাকে কখনো শঙ্খ, কখনো পদ্ম, কখনো পাতা বা কখনো বরাভয় মুদ্রা।

টুসু পূজা পার্বণে প্রয়োজনীয় উপকরণ:

প্রতিটি পূজায় অথবা কোন উৎসব পালনে কিছু উপকরণ প্রয়োজন তো পড়েই, তেমনি টুসু পূজায় যে সমস্ত উপকরণ গুলি অবশ্যই প্রয়োজন পড়বে সেগুলি নিচে দেওয়া হল:-

  • আতপ চাল,
  • আকন্দ ফুল,
  • বাসক ফুল,
  • তাজা যে কোন ফুল,
  • গাঁদা ফুলের মালা,
  • কারুলি বছরের গোবরের মন্ড,
  • তুষের উপর ধান,
  • হলুদ রঙের টিপ,
  • চিড়ে,
  • গুড়,
  • বাতাসা,
  • মুড়ি,
  • ছোলা,
  • দুর্বাঘাস,
  • পিঠে তৈরির জন্য বিভিন্ন উপকরণ,
  • চালের গুঁড়ো,
  • নানা রকম মিষ্টান্ন,
  • ছোলা ভাজা,
  • মটর ভাজা,
  • জিলিপি ইত্যাদি।

টুসু পূজা ও টুসু উৎসব পালনের নিয়ম সম্পর্কে জানা যাক:

টুসু উৎসব সাধারণত অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত টানা একমাস ধরে চলে। এই সময় ধানের ক্ষেত কিন্তু ধান গাছে ভরে থাকে। চারিদিক শস্যশ্যামলা জন্মভূমি লক্ষ্য করা যায়। শীতের মাঝে এই উৎসব চারিদিকে এক খুশির আমেজ বজায় রাখে। এই টুসু উৎসব পালন করা হয় খুবই আনন্দ আর খুশি মিশিয়ে, কিভাবে পালন করা হয় উৎসব চলুন জানি।

  • ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিড়িতে রেখে দেওয়া হয়।
  • অগ্রহায়ন মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের সকল কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো দিয়ে তাতে তুষ রাখেন।
  • এরপর তুষের উপর ধান, তারপর কারুলি বছরের গোবরের মন্ড।
  • এরপর একে একে দুর্বা ঘাস, আতপ চাল, আকন্দ ফুল, কাঁচা তাজা ফুল, গাঁদা ফুলের মালা, এগুলি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে সেই পাত্রটি কে পিড়ি বা কুলুঙ্গির উপর রেখে টুস স্থাপন করতে হয়।
  • এই পাত্রের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজা করা হয়।
  • পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধভাবে টুসু দেবীর কাছে তাঁদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন যাকে টুসু গান বলা হয় এবং দেবীর উদ্দেশ্যে চিড়ে, গুড়, বাতাসা, ছোলা, মুড়ি ইত্যাদি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।
  • টুসু উৎসব পালনের সময়কালে পৌষ মাসের শেষ চার দিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত।
  • চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠান গোবর মাটি দিয়ে খুব সুন্দর করে লেপে থাকেন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে চারিদিকে গুছিয়ে রাখেন।
  • তারপর চালের গুঁড়ো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠে তৈরি করা হয়।
  • এর পাশাপাশি আলপনা ও দিয়ে থাকেন অনেকেই।
  • এরপর বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কণাকৃতির পিঠে তৈরি করে তাতে ছাঁচি, তিল, নারকেল অথবা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়।
  • স্থানীয়ভাবে এই পিঠে গড়গড়া পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠে নামে সকলের কাছে পরিচিত।
  • এই দিন রাত ১০ টা থেকে টুসুর জাগরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
  • মেয়েরা এই উৎসবে ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজিয়ে থাকেন।
  • এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্ক মহিলারাও টুসু গান গেয়ে টুসু দেবীর আরাধনা করে থাকেন।
  • আবার টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানা রকমের মিষ্টান্ন, মটর ভাজা, মুড়ি, জিলিপি, ছোলা ভাজা এইগুলি নিবেদন করা হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলি প্রসাদ হিসেবে সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

টুসু দেবীর বিসর্জন:

পৌষ সংক্রান্তি অথবা মকর সংক্রান্তির ভোরবেলায় সকল কুমারী মেয়েরা এবং গৃহস্থ বাড়ির সকল মেয়েরা দলবদ্ধভাবে টুসু গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ অথবা কাঠের তৈরি রঙিন কাগজে সাজিয়ে দোলায় বসিয়ে নদী অথবা পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়।

যেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি কথা বলতে থাকেন ছড়া আকারে এবং গান গাইতে থাকেন। তার সাথে সাথে দেবীকে বিসর্জন করা হয়। টুসু বিসর্জন এর পরে সকল মেয়েরা নদী অথবা কুকুরের স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করেন।

ছেলেরা খড়, কাট, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়া ঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান। আর এই ভাবেই টুসু দেবীর বিসর্জন সম্পন্ন করে তাঁরা বাড়ি ফিরে আসেন।

টুসু গানের তাৎপর্য ও ঐতিহ্য:

টুসু উৎসবের সাথে টুসু গানের কতখানি গভীর সম্পর্ক রয়েছে তাতো শুধু এই উৎসব পালনকারীরা ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন। এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল টুসু গান অথবা টুসু সংগীত। এই গানের মূল বিষয়বস্তু হলো লৌকিক ও দেহগত প্রেম।

এই গানের মূল বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে যিনি এই গান গাইবেন গায়ক অথবা গায়িকা, তিনি কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতা কে ব্যক্ত করেন। এছাড়া এই উৎসবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যাঁরা পালন করেন তাঁরা হলেন কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা।

তাঁদের সংসারের সুখ, দুঃখকে এই সংগীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। এর পাশাপাশি গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ থেকে শুরু করে ঈর্ষা, ঘৃণা, কারোর প্রতি হিংসা অস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া রাজনীতির কথাও কিছু ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে এই গানে।

এই সমস্ত গানে পণপ্রথা, সাক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলা, সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়ে থাকে। যা একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সামাজিক পরিস্থিতি উপহার দিতে পারে সকল মানুষকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!