Worldwide Bengali Panjika

কিরীটেশ্বরী দেবী পূজা – Kiriteswari Puja


কিরীটেশ্বরী দেবী পূজা (Kiriteswari Puja): সনাতন ধর্মে বিভিন্ন দেবদেবীর মধ্যে কিরীটেশ্বরী দেবী, দেবী পার্বতী অথবা মা দুর্গার আরও একটি রূপ। এই মন্দিরের কালীপূজা (Kali Puja) খুবই প্রাচীন বলে অনেকেই জানবেন, দেবীর ৫১ টি পীঠের মধ্যে নবগ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দির হল অন্যতম মন্দির।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

কাহিনী অনুসারে জানা যায় দক্ষযজ্ঞের সময় মহাদেব যখন তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন দেবী পার্বতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তখন নারায়ণ চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করেন, সতীর দেহের সেই টুকরো অংশ যেখানে যেখানে পড়ে সেখানে সেখানে গড়ে ওঠে এক একটি সতীপীঠ, তবে এই কিরিটেশ্বরী তে দেবীর মুকুট পড়েছিল।

ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যে, কিরীটেশ্বরী (Kiriteswari) বেশ প্রাচীন, অনেক আগে কিরীটেশ্বরীতে বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের বসবাস ছিল, পরবর্তীতে কোন এক কারণে তাঁরা কিরীটেশ্বরী ত্যাগ করে চলে যান, এমনকি এখানকার যে মূর্তি রয়েছে সেটা বৌদ্ধ আদলেই তৈরি করা বলে মনে করা হয়। একসময় মন্দিরের সংস্কার করেন রানী ভবানী।

মন্দির ওই সময় রানী ভবানীর জমিদারির মধ্যে পড়তো, তাই তিনি এটি সংস্কার করেন এছাড়াও আরো জানা যায় নবাব মীরজাফরের যখন কুষ্ঠ রোগ হয় তখন নবাব কোন কিছুতেই এই রোগ থেকে সরে উঠতে পারছিলেন না, সে ক্ষেত্রে কিরীটেশ্বরীতে মানত করার পর, মায়ের চরণামৃত পান করার পর এই রোগ সেরে যায়। তারপর থেকে দেবীর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মন্দিরের পাশে “কালী সাগর” নামে যে বড় পুকুরটি রয়েছে সেটা মীরজাফর খনন করিয়েছেন।

কিরীটেশ্বরী দেবীর পূজা:

এই মন্দিরে দেবী শিলাস্বরূপা, দেবীর কোন মূর্তি বা ছবি এখানে পূজিত হয় না, একটি লাল বর্ণের শীলাকে দেবী কিরীটেশ্বরী রূপে পূজা করা হয়। কিরীটেশ্বরী মন্দিরের চূড়া অনেকটা পেঁয়াজের আকৃতির মত, মন্দিরের গর্ভগৃহের তিন দিকে বারান্দা এবং প্রতি বারান্দায় পাঁচটি করে খিলান রয়েছে। তাছাড়া কালী পূজার দিন প্রচুর মানুষের সমাগম এই মন্দিরে লক্ষ্য করা যায়।

এই মন্দিরের কাছাকাছি একাধিক মন্দির আছে, আর যেহেতু এখানে দেবীর কোন অঙ্গ পতিত হয়নি অর্থাৎ দেবীর মুকুট পতিত হয়েছিল তাই এই স্থানকে অনেক তন্ত্রবীদ পূর্ণ পীঠস্থান না বলে ‘উপপীঠ’ বলে থাকেন। আর এখানে দেবী বিমলা এবং তার ভৈরব সম্বর্ত নামে পূজিত হন।

মুর্শিদাবাদের কিরীটকোনা গ্রামে পড়েছিল দেবীর মাথার মুকুট কিছু মত অনুসারে জানা যায়। তাই দেবীকে এখানে কিরীটেশ্বরীর পাশাপাশি মুকুটেশ্বরী নামেও ডাকা হয়। ১৮ শতকের প্রথম দিকে পশ্চিম মুখী বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছেন বঙ্গাধিকারী দর্পনারায়ণ রায়।

মন্দিরের গর্ভগৃহে বিগ্রহ নেই, মন্দিরের ভিতরে একটি মর্মর বেদীর উপরে কালো পাথরের পিঠীকা রয়েছে সম্ভবত তার ওপর দেবীর কিরীট অথবা মুকুট আছে। বর্তমানে ওই কিরীট তবে মতান্তরে অনেকে কপালের হাড় বলে মনে করেন গ্রামের একধারে ‘গুপ্তমঠ’ নামে একটি মন্দিরে লাল রেশমি কাপড়ের মুড়ে একটি কলসের মধ্যে রাখা আছে।

নাটোরের সাধন অনুরাগী রাজা রামকৃষ্ণ শক্তি সাধনার জন্য এখানে আসতেন, তিনি যে দুটি পাথরে বসে সাধনা করতেন সেই পাথর দুটি এখনো পর্যন্ত মন্দির প্রাঙ্গণের সামনে রাখা রয়েছে।

কিরীটেশ্বরী দেবীর একটি প্রাচীন গল্প:

প্রায় ৩০০ বছর আগে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় পান্ডারা মূল পশ্চিম মুখী মন্দির থেকে দেবীকে বর্তমান গুপ্তমঠে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিয়ে আসার সময় পান্ডারা মায়ের রূপ দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং কয়েকজন পান্ডা মায়ের রূপ দেখেন, মায়ের রূপ দেখামাত্রই মায়ের রূপ দর্শনকারী পান্ডারা অন্ধ হয়ে যান।

এই ঘটনার পরেই অন্যান্য পান্ডারা মায়ের রূপ দর্শন করতে ভয় পান এবং আর দর্শন করতে চান না। কিন্তু মায়ের রোষানলে পড়ে ১৭২ ঘর পান্ডা পরিবার বিনাশ হয়ে যায়। আর এই ঘটনা আজও সকলের মনে দেবীকে নিয়ে এক ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভয়ের সঞ্চার করে।

কিরীটেশ্বরী দেবীর পূজায় ভোগ:

গুপ্তমঠে প্রতিদিন সকালে দেবীর নিত্য পূজা হয়, দুপুরে ভাজা, তরকারি ও মাছ সহযোগে অন্নভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পুরোহিত যিনি রয়েছেন তিনি বলেন যে ৩৬৫ দিন দেবীর অন্ন ভোগে মাছ দিতেই হয়।

মাছ ছাড়া দেবীর ভোগ হয় না বলেই জানান তিনি। দেবীর ভোগের মাছ ভক্তরা যোগান দেয়, প্রতিদিন কেউ না কেউ ভোগের আগে মন্দিরে মাছ দিয়ে যায়। কালী পূজার দিন সারারাত ধরে মায়ের পূজা হয়, পুজো শেষে ছাগল বলি দেওয়া হয় এখানে, এই বলি প্রথা আজও প্রচলিত।

এছাড়াও দুর্গা পূজার অষ্টমীর শুভ তিথিতে গুপ্তমঠে মায়ের মহা পূজার আয়োজন করা হয়, মহাপূজা উপলক্ষে মন্দির কে রং করার পাশাপাশি সুন্দর আলো ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়।

এই পূজার সময় গুলিতে কিরীটেশ্বরী মন্দিরে মানুষ মানতের পূজা দিতে আসেন। মহা পূজার দিন সকালে মায়ের মহাস্নান হয়। এরপর দিনভর চলে হোম যজ্ঞ। যজ্ঞ শেষ করে মানতের ছাগল বলিদান দেওয়া হয়। তারপর মহা পূজা দেখতে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয় এই মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরে উপস্থিত সকল ভক্তদের মধ্যে মায়ের মহা পূজার প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

কিরীটেশ্বরী দেবীর পূজা উপলক্ষে মেলা:

কিরীটেশ্বরী এটি শুধুমাত্র একটি মন্দির কিন্তু নয়, এটি একটি মহাপীঠ অথবা উপপীঠ যাই বলুন না কেন এটি কিন্তু হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এখানে প্রতি বছর এবং সারা বছর ভক্তদের সমাগম ঘটার পাশাপাশি অনেক পর্যটকরাও এখানে আসেন।

তবে পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার মূল মন্দিরের সামনের মাঠে মেলা বসে। পৌষ মাসে কিরীটেশ্বরী মেলা দেখতে মুর্শিদাবাদ সহ পাশের জেলা মালদা, বীরভূম, নদীয়া থেকেও প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!