Worldwide Bengali Panjika

রান্না পূজার পদ্ধতি ও নিয়ম – Ranna Puja


রান্না পুজা (Ranna Puja): রান্না পুজায় চলে বিভিন্ন ধরনের রান্নার তোড়জোড়, জানুন এই পূজার মাহাত্ম্য – বাঙ্গালীদের বারো মাসে যেমন তেরো পার্বণ, তেমনি বাঙালিরা বরাবরই খাদ্য রসিক। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে নতুন নতুন খাবারের আয়োজন করতে ভোলেন না।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

বাড়িতে হোক অথবা সার্বজনীন কোন পূজা, সেক্ষেত্রে ঈশ্বরকে অর্পণ করার পাশাপাশি নিজেদের জন্য এবং আশেপাশের সকলের জন্য তৈরি করা হয় সুস্বাদু বিভিন্ন ধরনের খাবার দাবার। তবে এমন কিছু উৎসবের মধ্যে একটি এমন উৎসব রয়েছে যা শুধুমাত্র মেয়েদের হাতের গুনেই প্রকাশিত পেয়েছে, আজ বর্তমানে ছেলেরাও সেই কাজে হাত মিলিয়েছেন।

বাঙালির প্রিয় রান্না পূজা:

এই পূজার নাম হল ‘রান্না পূজা’, নির্দিষ্ট কিছু বিধান মেনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম অঞ্চল থেকে শুরু করে এই পূজা এখন শহরেও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই পূজাকে অনেকে ‘ইচ্ছা রান্না’ (Iccha Ranna) বলে থাকেন কোথাও বা ‘ধরাতে রান্না’ (Dharate Ranna) আবার ‘আটাশে রান্না’ (Atashe Ranna) আবার কোথাও বলে ‘বুড়ো রান্না’ (Buro Ranna)

আর এই পার্বণটি একমাত্র সেখানকার স্থানীয় মানুষদের নামকরণ হিসেবেই সকলেই চিনে থাকেন। এই পূজায় বিশেষ করে রান্না কে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন ধরনের রান্না হয় এই দিন। তবে এই পূজার একটি বিশেষ গুরুত্ব হল এর পরের দিন রয়েছে বিশ্বকর্মা পুজো।

সেদিন সম্পূর্ণরূপে ‘অরন্ধন’ (Arandhan) অর্থাৎ কোনরকম রান্না চলবে না অথবা উনুনে আগুন জ্বলবে না। সেক্ষেত্রে এই রান্না পূজার দিন রান্না করা বাসি খাবার তার পরের দিন সারাদিন ধরে খাওয়া চলে।

ভাদ্র সংক্রান্তি (Bhadra Sankranti) বা বিশ্বকর্মা পূজার (Vishwakarma Puja) আগের দিন পরিবারের কল্যাণ সাধনে বাড়ির গৃহিণীরা শিবের মানস পূত্রী দেবী মনসার উদ্দেশ্যে নানারকম রান্না করা পদ নিবেদন করে থাকেন। তবে এই দিন মনসা পূজাও করা হয়, যেহেতু চারিদিকে বর্ষাকাল তাই সাপেদের থেকে নিস্তার পেতে এই দিন এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তার সাথে সাথে চলে বিভিন্ন ধরনের রান্না বান্না।

সারারাত ধরে রান্নারও কাজ চলে, রান্না পুজোর দিন সাধারণত উনুনের পূজা করা হয়। সারা বছর আমরা যে উনুনে রান্না করে খাবার তৈরি করে খেয়ে থাকি তার উপাসনা করা হয় এই পূজায়। অন্যদিকে উনুনের গর্ত হল মা মনসার প্রতীক, তাই দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা বোঝাতেই এই উনুন পূজা করা হয়ে থাকে।

উনুন পূজা করার কারণ কি?

আসলে দেবী মনসা বাংলার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অন্যতম একজন দেবী। ভরা বর্ষা কাটিয়ে যখন সূর্যের আলো ঝলমল করে ওঠে সেই রোদ ভূমিপৃষ্ঠ স্পর্শ করে, তখন শীতকালে শীত ঘুমে যাওয়ার আগে গ্রামাঞ্চলে সাপের আনাগোনা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়।

চাষ করতে গিয়ে অনেক মানুষের জীবনহানি হয় সাপের কামড়ে। তাই দেবী মনসাকে সন্তুষ্ট করতে, সংসার জীবনে দেবীর কৃপা লাভ করতে সেই আশা নিয়ে রান্না করা পান্তা ভাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনে ভাজাভুজি, মাছের বিভিন্ন ধরনের পদ, বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করে দেবীকে নিবেদন করা হয়।

তবে এখানে একটি নিয়ম আছে যে, সারারাত ধরে রান্না করতে হয় ঠিকই, তবে সূর্যের আলো যেন যেখানে রান্না করা হয় সেখানে প্রবেশ না করে অর্থাৎ সমস্ত রান্না সূর্য উদয়ের আগেই সম্পন্ন করতে হবে আর যদি না হয়ে ওঠে তাহলে সেই জায়গাটা অন্ধকার করে রাখতে হবে যেকোন উপায়ে।

রান্না পূজার পদ্ধতি ও নিয়ম:

দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসব রান্না পূজা বলে বিশেষভাবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবে এই পূজার জন্য দৈনন্দিন ব্যবহারের উনুন সুন্দর করে গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয় এবং আলপনা দিয়ে, মনসা পাতা দিয়ে সাজিয়ে ঘট স্থাপন করে পূজা শুরু করতে হয়।

মাটির হাঁড়িতে পূজার ভাত রান্না করা হয় এবং সেই হাঁড়ির গলাতে শাপলা ফুল দিয়ে সুন্দর মালা তৈরি করে পড়ানো হয়। এছাড়া উনুনের গায়ে সিঁদুরের ফোটা দেওয়া হয়। তারপরে চলে রান্নার কাজ, প্রথমে পূজার ভাত যা পরবর্তীতে জল ঢেলে পান্তা করা হয় সেটা রান্না করা হয় তারপরে আস্তে আস্তে একে একে সমস্ত রান্না সম্পন্ন করা হয়।

রান্না পূজায় যে সমস্ত পদ রান্না হয়:

রান্না পূজায় যে সমস্ত পদ রান্না হয় তা তার পরের দিন সারাদিন ধরে খাওয়া যাবে এমন ভাবে রান্না করা হয়, অর্থাৎ সবকিছুতে থাকে একটা শুকনো ভাব, যেন কোনভাবে তাতে কোন খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় না থাকে।

এক্ষেত্রে পান্তা ভাত থাকে, মুগের ডাল যা খুবই শুকনো ভাবে তৈরি করা হয় অনেকে একে ডাল চচ্চড়িও বলে থাকেন, কচু শাক, লতি চচ্চড়ি, পাঁচ রকম ভাজা অথবা অনেকেই পাঁচ রকম ভাজার থেকেও বেশি ভাজা করে থাকেন, আলু কুমড়ো নারকেল দিয়ে তরকারি, ইলিশের ভাজাও থাকে অথবা তরকারিও থাকে, ভেটকি মাছ থাকে, চিংড়ি মাছ থাকে, ভাপা ইলিশ, চিংড়ি মাছের বিভিন্ন পদ, চালতার চাটনি থেকে শুরু করে পায়েস, পিঠে সবকিছুই থাকে।

মোট কথা আমরা সারা বছরে রান্না করে যে সমস্ত খাবার খেয়ে থাকি সেই সবকিছুই এই রান্না পুজোর দিন অল্প অল্প করে রান্না করা হয়। এখনো পর্যন্ত গ্রামবাংলায় অরন্ধনের আগের দিন বাড়ির সকল সদস্য মিলে এবং আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে আনা হয়, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সারারাত ধরে রান্নার কাজ চলে এবং রান্নাবান্না থেকে শুরু করে কুটনো কাটা, বাটনা বাটা, সবকিছু চলে আর আনন্দের সাথে রান্না করা হয় এবং সারা রাতটা কাটানো হয় না ঘুমিয়ে।

ভাদ্র সংক্রান্তির (Bhadra Sankranti) দিন মা মনসা কে উৎসর্গ করা হয় এই পূজা, তবে সারাদিন ধরে আশেপাশের সকলের নিমন্ত্রণ করে আনা হয় এবং সারাদিন ধরে চলে খাওয়া দাওয়া। এই রান্না পূজা উপলক্ষে গোত্র এবং অঞ্চল ভেদে কেউ কেউ মনসার মূর্তি বানিয়ে বা ঘট স্থাপন করে অথবা ফনিমনসার ডাল পুঁতে যা মনসার প্রতিক হিসেবে ভেবে পূজা করা হয় সেখানে বেশ বড় আকারে পূজা-অর্চনা করা হয় পুরোহিত ডেকে।

আগে তিথি অনুযায়ী সংক্রান্তির দিন ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন পড়লে তবেই সেই খাবার মুখে তুলতেন গৃহস্থ বাড়ির সকলে। তাই এই উৎসবকে অনেকে বলতেন যে “ভাদ্র মাসে রান্না করে আশ্বিনেতে খাওয়া”। আবার অনেকেই মজা করে বলেন যে “এই মাসে রান্না করে ওই মাসে খাওয়া”

তবে এই রান্না পূজা সকলের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় না। এটা জানা যায় যে এই পূজা বংশ পরম্পরায় চলে আসে, সকল বাড়িতে এই রান্না পূজা থাকে না। তাই যাঁদের বাড়িতে রান্না পূজা থাকে তাঁদের আশেপাশের সকল মানুষকে নিমন্ত্রিত করে নিজের বাড়িতে ডেকে এই পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।

এর পাশাপাশি চলে ঘুড়ি ওড়ানোর একটা উৎসব যা এই রান্না পূজা এবং বিশ্বকর্মা পূজার সাথেই খুব ভালোভাবে জড়িত। অনেক জায়গায় এই ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়। এটা একটা বড় উৎসবের আকার নেয় সেখানে বহু মানুষ ভিড় জমিয়ে থাকেন।

তবে সারা বছর বাসি খাবার খাওয়ার অতটা আগ্রহ না থাকলেও রান্না পূজার এই সময়টা এই যে বাসি খাবার সারাদিন ধরে খাওয়ার আগ্রহটা যেন বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়, আর এই খাবারে কোনরকম কোন অরুচি থাকে না, কেননা সমস্ত খাবারই থাকে মুখরোচক। এছাড়া মা মনসার আশীর্বাদে এই খাবার অনেকের অনেক কঠিন রোগ সারিয়ে দেয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

চারিদিকে বৃষ্টি মুখর পরিবেশ এবং কলাপাতায় বিভিন্ন ধরনের ভাজা থেকে শুরু করে মাছ চাটনি পিঠে আপার ফের পান্তা ভাত এক আলাদা আনন্দ এই আনন্দ যেন দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঠিকই তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো পর্যন্ত রান্না পূজার গুরুত্ব একটুও কমে যায়নি। এই পূজার আনন্দ ভাগ করতে অনেকেই শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে চলে যান নিজের বাড়িতে অথবা কারোর নিমন্ত্রণে। এছাড়া যারা শহরে বসবাস করেন তারাও কিন্তু খুবই নিষ্ঠার সাথে এই পূজা পালন করে থাকেন এবং যতটা সম্ভব সাধ্যমত রান্না পূজার সকল রীতি মেনে রান্না করে থাকেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!