কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা (Kojagari Lakshmi Puja): দেবী লক্ষ্মী প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করতে সেই গৃহস্থের বাড়ির থেকে পূজা নিয়ে থাকেন। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী দেবীর পূজা করে থাকেন ঘরের মা ও বোনেরা। এছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি (Bhadra Sankranti), পৌষ সংক্রান্তি (Poush Sankranti) ও চৈত্র সংক্রান্তিতে (Chaitra Sankranti) এবং আশ্বিন পূর্ণিমা (Aashin Purnima) ও দীপাবলিতে (Diwali) লক্ষ্মী দেবীর পূজা করা হয়।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
শারদীয়া দূর্গা উৎসব (Sharadiya Durga Utsav) এর পরেই এই শুক্ল পক্ষের অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের শেষের যে পূর্ণিমা, সেই তিথিতে কোজাগরি লক্ষ্মী পূজা খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রতিটি বাঙালি হিন্দু ঘরে ঘরে হয়ে থাকে। এই দিন সারারাত জেগে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবী লক্ষ্মীকে ঘরে আগমন জানানোর অপেক্ষা করা হয়। ধন-সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরি লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে, নারী পুরুষ উভয়ে কিন্তু এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন।
ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী হলেন মা লক্ষ্মী, লক্ষ্মী মানে শ্রী, শুরুচি, লক্ষ্মী সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাঁকে পূজা করা হতো। তবে পরবর্তীকালে দিন বদলের সাথে সাথে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে কল্পনা করা হয়। দেবী সকলের মনোবাসনা পূরণ করেন এবং অলক্ষ্মীকে বিতাড়িত করেন সংসার থেকে। দেবী পদ্ম ফুলের উপরে বিরাজ করছেন। দেবী লক্ষ্মী সকলকে যশ খ্যাতি, ধন সম্পদ ও সৌন্দর্য প্রদান করেন।
এছাড়া ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মা পুরাণ অনুসারে জানা যায় ভিভো পত্নী খ্যাতির গর্ভে শ্রী দেবী লক্ষ্মীর জন্ম। শত পথ ব্রাহ্মণে অবশ্য বলা হয়েছে যে শ্রীদেবী, প্রজাপতি অর্থাৎ ব্রম্ভা থেকে উৎপন্ন হয়েছেন এবং তিনি ধনসম্পদ, সৌন্দর্য ও সৌভাগ্য প্রদান করেন। এছাড়া মা লক্ষ্মীকে অনেকেই আরদ্রা, গজশুন্ডাগ্রবতী, পিঙ্গল বর্ণা, পুষ্টি রুপা, পদ্ম মালিনী, হিরণ্ময়ী, চন্দ্রাভা, সুবর্ণা, ষষ্ঠী হস্তা, হিমমালিনী, সূর্যাভা প্রভৃতি নামে সম্বোধন করে থাকেন।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আচার অনুষ্ঠান:
কোজাগরি লক্ষ্মী পূজাতে দেখা যায় অঞ্চল ভেদে এবং জায়গা অনুযায়ী আচার অনুষ্ঠান একটু সেই জায়গার স্থানীয় কিছু নিয়ম যুক্ত থাকে। এখনো ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করে তাঁর আরাধনা করা হয়। এই পূজায় ফল, মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া নাড়ু ইত্যাদি।
লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানে দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য, কোন কোন পরিবারে পূজায় মোট ১৪ টি পাত্রে উপকরণ রাখা হয়। সেই উপকরণ গুলি হল:- কলা পাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, কড়ি, ধান, পান, হরিতকি ও হলুদ দিয়ে সাজানো হয় পূজার জায়গাটি।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় প্রয়োজনীয় উপকরণ:
লক্ষ্মী দেবীকে সন্তুষ্ট করতে এই যে উপকরণ গুলি প্রয়োজন পড়বে সেগুলি হল:-
- দেবী লক্ষ্মীর শাড়ি,
- নারায়ণের ধুতি,
- লোহা,
- শঙ্খ,
- সিঁদুর,
- কড়ি,
- বালি,
- খোড়কে,
- কাঠ,
- পরিমাণ মতো ঘি,
- হোমের জন্য ২৮ টি বেলপাতা,
- ধুপ,
- পঞ্চ প্রদীপ,
- প্রদীপ,
- কর্পূর,
- ধূপকাঠি,
- ধুনুচি,
- দুর্বাঘাস,
- ১ টি ঘট আচ্ছাদন গামছা,
- ১ টি কুণ্ড হাড়ি,
- ১ টি তেকাঠি,
- ১ টি দর্পণ,
- পঞ্চগুড়ি,
- পঞ্চগব্য,
- পঞ্চরত্ন,
- ১ টি শীষযুক্ত ডাব,
- চারটি তীর কাঠি,
- ফুল,
- টাকার কয়েন,
- পান,
- হলুদ,
- ঘট,
- এক সরা চাল,
- আতপ চাল,
- দই,
- মধু,
- চিনি,
- চন্দ্রমালা,
- পূর্ণ পাত্র ও হরিতকি,
- আসন আঙ্গুরিয়ক,
- ভোগের দ্রব্য,
- চিড়ে,
- নারকেল দক্ষিণা ইত্যাদি,
- তবে মনে রাখতে হবে যে লক্ষ্মী পূজায় কিন্তু ফলের মধ্যে কলা নিষিদ্ধ রয়েছে।
মা লক্ষ্মীর প্রিয় ফুল:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় মা লক্ষ্মীর প্রিয় ফুল অর্পণ করুন:
করবী ফুল, গাঁদা ফুল, পদ্ম ফুল, নীল রঙের জবা ফুল যা খুবই বিরল, তবে অবশ্যই বিভিন্ন রঙের পদ্ম ফুল লক্ষ্মী পূজায় রাখতে পারেন, যা মা লক্ষ্মীর খুবই পছন্দের ফুল।
কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার নিয়ম:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, এই পূর্ণিমার দিন বাড়িতেই বাড়ির গৃহিণীরা নিজেরাই পুরোহিত ছাড়াই এই পূজা সম্পন্ন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং সেই নিয়ম অনুযায়ী কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সম্পন্ন করতে হয়।
- লক্ষ্মী পূজার পদ্ধতি হিসেবে শুদ্ধ আসনে বসে আচমন থেকে শুরু করে পঞ্চ দেবতার পূজা সম্পন্ন করতে হয়।
- লক্ষ্মী দেবীর ধ্যান করে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দেবী লক্ষ্মীকে পূজা করা হয়।
- লক্ষ্মী পূজাতে পঞ্চ উপাচার, ১০ উপাচার, আলাদা ষোল উপাচারে করা হয়ে থাকে। পূজার মৌলিক নীতি হিসেবে লক্ষ্মী দেবীর ধ্যান, পূজা, পুষ্পাঞ্জলি, মন্ত্র পাঠ, প্রণাম মন্ত্র পাঠ করতে হয়, তারপর অবশেষে বিসর্জন দিতে হয়।
- প্রত্যেক দেবদেবীর এক একটি নিজস্ব কিছু রীতিনীতি, মন্ত্র নির্ধারিত থাকে, পূজার সময় সঠিকভাবে পূজা করাটাও একটা মহৎ ও শুভ কাজ। মা লক্ষ্মীর পূজাতে পূজার মন্ত্র পাঠ করে সুষ্ঠুভাবে এই পূজা সম্পন্ন করা উচিত।
- পূজা অর্চনা জেনে নিয়ে ভালো করে সবকিছু আয়ত্ত করে তবেই কিন্তু এই পূজায় অংশগ্রহণ করতে হয়, না হলে জেনে না জেনে ভুল করলে কিন্তু অমঙ্গল হতে পারে।
- প্রাচীনকাল থেকে মা লক্ষ্মী দেবীর প্রচলিত কিছু আচার অনুষ্ঠান, ধরন ও প্রথা রয়েছে। স্নান করে পরিষ্কার হয়ে শুদ্ধ কাপড় পরে লক্ষ্মী গায়ত্রী মন্ত্র ১০৮ বার জপ করলে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন মা লক্ষ্মী।
- দেবীর পায়ের চিহ্ন আঁকা হয় আতপ চালের আটা দিয়ে। প্রতিদিন না পারলেও বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার এবং মা লক্ষ্মীর পূজার তিথি থাকলে অবশ্যই ঘরে এবং ঠাকুরঘরে মা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন আঁকতে হবে।
- লক্ষ্মী দেবীর প্রতিমা অথবা পটের সামনে দুটি ঘি এর প্রদীপ জ্বালাতে হবে যা মঙ্গলজনক। এর সঙ্গে পদ্মফুল, ক্ষীরের নৈবেদ্য, নারকেল এগুলি দিলে দেবী খুবই প্রসন্ন হন।
- ঠাকুর ঘরে বা ঠাকুরের সিংহাসনে কড়ি এবং শঙ্খ রাখা খুবই শুভ গৃহের কল্যাণের জন্য।
- মঙ্গল ঘট পরিষ্কার জল দিয়ে ভর্তি করতে হবে, ঘটের উপরে শিস যুক্ত ডাব অথবা নারকেল রাখতে হবে।
- ঘটের গায়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকতে হবে যা সমৃদ্ধির প্রতীক।
- ঘট লাল কাপড়ে মুড়ে রাখুন, লাল সুতো দিয়ে বেঁধে রাখুন।
- ঘটের মধ্যে অথবা ঘটের জলে চাল ও মুদ্রা রাখুন।
- পূজা সম্পন্ন হওয়ার পরে অবশ্যই লক্ষ্মীর পাঁচালী অথবা ব্রতকথা পাঠ করতে হবে, যদি না পাঠ করতে পারেন তাহলে অবশ্যই শ্রবণ করতে হবে।
কোজাগরি লক্ষ্মী পূজায় যেগুলি করবেন না:
১) লক্ষ্মী পূজায় লোহা অথবা স্টিলের বাসন বা কোন পাত্র ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়। কেননা লোহা দিয়ে অলক্ষ্মীর পূজা করা হয়, তাই লোহা দেখলে দেবী লক্ষ্মী খুবই রেগে যান এবং সেই জায়গা খুব দ্রুত ত্যাগ করেন।
২) লক্ষ্মী দেবী খুবই চঞ্চলা এবং শান্ত প্রকৃতির, এর মানে হল তিনি কোলাহল পছন্দ করেন না আর তিনি এক জায়গায় যদি নিজের মন মত পরিবেশ না হয় তাহলে সেখানে বেশিক্ষণ থাকেনও না। তাই লক্ষ্মী পূজায় ঘন্টা বাজাতে নেই, কোন রকম বাদ্যি বা বাজনা বাজাতে নেই, শুধুমাত্র শঙ্খ ধ্বনিতেই মা লক্ষ্মীকে আরাধনা করা হয়।
৩) দেবী লক্ষ্মীকে তুলসী পাতা দিতে নেই কিন্তু লক্ষ্মী পূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসী পাতা দিয়ে নারায়ণ কে পূজা করতে হয়। এটিই নিয়ম।
৪) লক্ষ্মী পূজা সাধারণত সন্ধ্যেবেলা হয়ে থাকে, তবে অনেকে সকালেও করে থাকেন, সকালে করলে সকাল ন’টার মধ্যে পূজা সেরে নেওয়াটা খুবই ভালো।