শারদীয়া দুর্গাদেবীর বোধন দুর্গা ষষ্ঠী (Durga Sasthi): শ্রেষ্ঠ পূজা হল দুর্গোৎসব, এই দুর্গা পূজার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় সারাটা বছর এবং একপ্রকার বলতে গেলে সারা বছর ধরে চলে এই পূজার আয়োজন।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
ষষ্ঠীর দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় দুর্গা পূজার আনন্দ উৎসব, দেবী দুর্গাকে বোধনের দিন হল এই ষষ্ঠীর দিন। যে দিনটিকে মহাষষ্ঠী (Maha Sasthi) বলা হয়, দেবি পক্ষে ষষ্ঠীতে দুর্গাকে বোধন করে পূজা করেছিলেন রামচন্দ্র। দুর্গার বোধনকে ঘিরে পৌরাণিক কাহিনীও রয়েছে।
তো চলুন তাহলে জানা যাক মহাষষ্ঠী কিভাবে পালিত হয় সে সম্পর্কে:
দেবীর বোধন:
বোধন (Bodhon) শব্দটির অর্থ হলো ‘জাগ্রত করা’। মর্ত্যে দুর্গার আবাহন এর জন্য বোধনের রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই শুভদিনে কল্পারম্ভ দিয়ে শুরু হয় দুর্গা দেবীর বোধন। ষষ্ঠীর সকালেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তারপরে দেবী দুর্গার সামনে প্রার্থনা করা হয়। যে ষষ্ঠী থেকে দশমিক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পূজা পর্বে যেন কোন রকম বিঘ্ন না ঘটে। এই পার্থনার পাশাপাশি ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের কোনে স্থাপন করতে হয়। এই স্থানে দূর্গা ও চন্ডীর পূজা করা হয়। তারপরে শুরু হয় দুর্গা দেবীর বোধন।
এর পরে আসে অধিবাস এবং আমন্ত্রণের পর্ব। বোধনের পর বেল গাছের শাখার দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অশুভ শক্তি দূর করার জন্য ঘটের চারপাশে তীর কাঠিতে সুতো জড়িয়ে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, এইভাবেই শেষ হয় মহাষষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান। বিশেষভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, বেল গাছের নিচে অর্থাৎ আটা বেল যেটা বলা হয় সেই গাছের নিচে ষষ্ঠীর দিনে বাড়ির মা ও বোনেরা দেবী দুর্গার আরাধনা করে থাকেন এবং প্রার্থনা করে থাকেন আর এটাকে দেবীর বোধন বলে।
দেবী বোধনের তাৎপর্য:
এই অনুষ্ঠানটির একটি পৌরাণিক তাৎপর্য রয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এই শুভদিনে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা, সঙ্গে থাকেন তাঁর চার সন্তান লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক এবং সরস্বতী। এই দিন দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচন করা হয় মনে করা হয় বোধনের পর প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। আর তারপর থেকেই চলে দুর্গাপূজার আনন্দ উৎসব।
বাংলার হিন্দু সমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রত গুলীর অন্তর্গত একটি সধবা ব্রত হল দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দু ঘরের মহিলারা সাংসারিক মঙ্গল কামনায় এই ব্রত পালন করে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে। এটি আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়ার দুর্গাপূজার বোধনের দিনে ষষ্ঠী পূজা হিসেবে পালন করা হয়।
দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত পালনের নিয়ম:
আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজার ষষ্ঠী অর্থাৎ শুক্লা ষষ্ঠীতে এই ষষ্ঠী পূজা করতে হয়, দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত পালনের প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে ফুল, ফল, ধূপ, প্রদীপ, দূর্বা ঘাস, আতপ চাল ও মিষ্টান্ন সংগ্রহ করতে হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে উপকরণ গুলি দিয়ে দেবীর পূজা করতে হয় আর এই দিন অন্ন অথবা ভাত খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মহাষষ্ঠী পূজার ব্রতকথা:
বহুদিন আগে এক বামন তার দুই ছেলে, তিন মেয়ে ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করত। ছোট ছেলে ছাড়া সকলেরই বিয়ে হয়েছে তবে ছেলেপুলে তখনও পর্যন্ত কারোর হয়নি। এক বছর ষষ্ঠীর আগের দিন বামন সকলকে ডেকে পুজোতে কে কি নিতে চায় তা জানতে চাইল। সকলেই সকলের পছন্দমত কাপড় জামা ইত্যাদি চাইলো কিন্তু বড় বউ কিচ্ছু চাইলো না।
অবশেষে শ্বশুর শাশুড়ির অনুরোধে সে একটা ধুলো মুঠি শাড়ি চাইল। এরপর বামন ফর্দ নিয়ে বাজারে গিয়ে সবার জন্য সব কিছু নিয়ে আসলো, কিন্তু বড় বউয়ের জন্য ধুলোমুঠি শাড়ি পেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও একটা বুড়ো দোকানীর দোকানে গিয়ে বামন ধুলোমুঠি শাড়ি চাইতে বুড়ো জানতে চাইলো, যে এই শাড়ি পড়তে চেয়েছে তার কি কোন ছেলেপুলে আছে ? উত্তরে বামন জানালো যে নেই। তখন বুড়ো দোকানী বলল যে, মা ষষ্ঠীর দয়া না হলে এই শাড়ি কেউ পরতে পারে না।
তাই সে ওই বামনকে বলল যে তার বড় বৌমা যেন পরের দিন ষষ্ঠী পূজা করেন। তাহলে মা ষষ্ঠী তার উপরে দয়া করবেন এবং তাহলেই সে ওই ধুলোমুঠি শাড়ি পড়তে পারবে। আসলে বামন নিজেই জানতো না যে ধুলোমুঠি শাড়িটা আসলে কি, এর অর্থ সেই বুড়ো দোকানদার এর কাছে জানতে চাইলে জানা যায় এর অর্থ হল সাদা ধবধবে লাল পাড় শাড়ি, যে শাড়িটা বাচ্চার মা পরে থাকা অবস্থাতে তার সন্তান ধুলো মেখে তার কোলে উঠতে চাইবে এবং সেই শাড়িতে ধুলোর দাগ লেগে যাবে। এটাই হলো ধুলোমুঠি শাড়ি। এই কথা শুনে বামন বাড়ি এসে যার যার কাপড় তার তার কাছে দিয়ে দিল।
আর বড় বউকে বললো বছর বছর ধরে শুক্লা ষষ্ঠীতে পূজা করতে এবং মানত করতে তবেই সে ওই কাপড় পাবে। এই কথা শুনে বড় বউ সেদিন নিরামিষ ভোজন করল, পরের দিন মা ষষ্ঠীর পূজা করল, তারপর কিছুদিনের মধ্যে সে গর্ভবতী হলো এবং সঠিক সময় মত একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। ছেলে হওয়ার আনন্দে সবাই বিভোর হয়ে উঠল, তার পরের বছর বড় বউ শাশুড়ি ও জা কে নিয়ে এই পূজা করল ফলে তাদের সকলের সন্তান হলো।
ছোট ছেলের বিয়ে হল তার কিছুকাল পর বড় বউ একটা লাল পেড়ে ধবধবে সাদা শাড়ি পরে আছে এমন সময় তার ছেলে ধুলো মেখে তার কোলে উঠতে এলো, বড় বউ তাকে কোলে তুলে নিল, ফলে তার সাদা শাড়িতে ধুলোর দাগ হয়ে গেল, এতে তার ধুলোমুঠি শাড়ি পড়ার সাধ পূরণ হল। এই দৃশ্য দেখে বামন আর বামনী পরম আনন্দিত হল। তারপর ধীরে ধীরে এই ব্রতকথা প্রচারিত হতে থাকলো, এই ব্রত সকলে পালন করতে থাকলো।
দুর্গা ষষ্ঠীর ব্রত পালনের শুভফল:
দুর্গা ষষ্ঠী পালন করলে এবং এই পূজা উপবাস রেখে ব্রত পালন করার মধ্যে দিয়ে যদি পূজা করা যায় তাহলে যে সমস্ত রমণী এই পূজা করবেন তাদের যদি সন্তান না থাকে তবে তাদের সন্তান হবে এবং সন্তান সুখ লাভ করার পাশাপাশি সংসারের সুখী হবে সকলের সাথে।