Worldwide Bengali Panjika

শ্রী শ্রী শ্যামা পূজা (কালী পূজা) পূজাবিধি – Kali Puja Vidhi


শ্যামা পূজা – Shyama Puja (কালী পূজা – Kali Puja): দূর্গা পূজার পরেই দেবী দুর্গা আবার আরেক রূপে আমাদের সকলের কাছে ফিরে আসেন। আর তিনি হলেন মা কালী অর্থাৎ অনেকেই তাকে শ্যামা মা বলেই ডাকেন। তার গায়ের রং শ্যামলা অথবা নীল, কালো বলেই এই নাম। শ্রী শ্রী শ্যামা পূজা ভারতের জাতীয় মহোৎসব বলা যেতে পারে। এই উৎসবের একটা বিশেষ মাহাত্ম্য হলো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব বিভিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

আর এটি দীপাবলি (Deepawali) অথবা দেওয়ালি (Diwali) নামে আখ্যায়িত করে থাকেন অনেকে। ঘোর অমাবস্যায় এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে চারিদিকে আলোর বন্যা বয়ে যায়। মোমবাতি থেকে শুরু করে প্রদীপের আলো, বিভিন্ন ধরনের লাইটিং যা প্রতিটি ঘর থেকে আশেপাশের সকল পরিবেশকে আলোক মালায় সাজিয়ে তোলে। বিভিন্ন দেবতার মধ্যে দেখা যায় শ্যামা পূজা অথবা কালী পূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

শ্রী শ্রী শ্যামা পূজা অথবা কালী পূজা:

গ্রামাঞ্চলে পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল তৈরি করে সেখানে প্রতিমা স্থাপন করা হয় এবং এক একটি মণ্ডপে মা কালীর রূপের পূজা করা হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার বিজয়ার পরবর্তী অমাবস্যার রাতে দীপাবলি পূজার আয়োজন করা হয় অর্থাৎ শ্যামা পূজার আয়োজন করা হয়। দীপাবলির রাতে অনুষ্ঠিত হয় এই শ্যামা পূজা অথবা কালী পূজা।

এক দিক থেকে বিশ্বাস করা হয় যে পৃথিবীর সকল অন্ধকার কে নিমিষেই দূর করতে এই আলোর উৎসবের আয়োজন। অশুভ শক্তির হাত থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যই আলোক মালা আমাদের সাহায্য করে। অন্ধকার রাস্তায় পথ দেখানোর জন্য আমরা যেমন আলোর ব্যবহার করি ঠিক তেমন।

কালীপূজার প্রচলন:

কালীপূজার (Kali Puja) এই উৎসব খুবই পুরনো তা কিন্তু নয়। ১৮ শতকে এই উৎসবটি বাংলার গ্রামাঞ্চলে স্বীকৃতি পায় এবং নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এটি শুরু করেছিলেন। কালী পূজা ১৯ শতকের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি অর্জন করেছিল। তার পাশাপাশি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি ঈশান চন্দ্র এই পূজা এবং উৎসবটি কে খুব বড় আকারে উদযাপন করার একটি প্রথা শুরু করেছিলেন। আর সেই প্রথা অনুসারে এই কালী পূজা দুর্গা পূজার মতোই বড় আকারে অনুষ্ঠিত হয় বর্তমানে।

কালী পূজার প্রকারভেদ:

যেহেতু মা কালীর অনেক রূপ, তবে এই কালী পূজাতে বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার এবং আসামের প্রধান যে তিনটি মূর্তির পূজা করা হয় সেগুলি হল:-

১) দীপান্বিতা কালীপূজা, বছরে একবার হয়, যা এই কালীপূজা হিসেবে সকলের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।

২) রটন্তী কালী পূজা, এই কালীপূজা হিন্দু বছরের মাঘ মাসের কৃষ্ণ চুর্দশীতে অনুষ্ঠিত হয়।

৩) ফল হারিনি কালীপূজা, এই কালী পূজা বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে পালন করা হয়।

কালী পূজার পদ্ধতি:

এছাড়া কালী পূজা দুটি পদ্ধতিতে পালন করা হয়, প্রথমত সাধারণ পদ্ধতিতে যেমন পূজা করা হয় তেমনভাবেই মা কালীর আরাধনা করা হয়ে থাকে প্রতিটি পূজা মন্ডপে এবং কালীমন্দিরে অথবা অনেক বাড়িতেও এই পূজা হয়ে থাকে।

এছাড়া, দ্বিতীয়ত তান্ত্রিক পদ্ধতিতে কালী মায়ের সাধনা করা হয়, যাঁরা তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাস করেন অথবা সাধক যাঁরা রয়েছেন তাঁরা এই কালীপূজা পালন করে থাকেন। মা কালীর মাটির মূর্তি তৈরি করা হয় এবং প্রতিষ্ঠা করার পরে তবে পূজা-অর্চনা শুরু করা হয়।

এজন্য প্যান্ডেল অথবা মণ্ডপ ইত্যাদি সাজিয়ে মাকে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজায় তান্ত্রিক আচারও করা হয় এবং মন্ত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে দেবীকে আরাধনা করা হয়।

কালী পূজার প্রয়োজনীয় উপকরণ:

কালী পূজায় যে সমস্ত উপকরণ গুলি প্রয়োজন পড়বে সেগুলি হল:-

  • লাল জবা ফুল অথবা রক্ত জবা ফুল এবং আরো অন্যান্য জবা ফুল সাথে অন্যান্য ফুল,
  • চন্দন,
  • মাথার খুলির ভিতরে পশুর রক্ত,
  • মিষ্টি ভাত,
  • মাছ,
  • মাংস,
  • মুশুর ডাল,
  • প্রদীপ ও লেখনি দোয়াত ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে,
  • মা কালী শুধু জবা ফুলেই সন্তুষ্ট হন,
  • সোমরস এই পূজা প্রধান ভোগ হিসেবে ব্যবহৃত করা হয় যা নেশা জাতীয় পানীয় বলা যায়।
  • লেখনী দোয়াত বা কালি দোয়াত গুলিতে অনামিকা আঙুল ডুবিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকতে হয় এবং এর সাথে লাল চন্দন বাটা ব্যবহার করতে হয়।

কালী পূজার নিয়ম বিধি:

মা কালী কে শক্তির দেবী হিসেবেই অনেকেই মনে করেন এবং ভগবান শিব যেমন সংহারের অধিপতি ঠিক একই ভাবে দেবী কালী কে সংহার বিনাশের অধিপতি দেবী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, দেবী কালীকে সর্বদা রাতে পূজা করা হয়ে থাকে এবং এটি নিয়ম তবেই কিন্তু পূজার ফল পাওয়া যায়। আমরা আগেই জেনেছি মা কালীর উপাসনা দুই প্রকারে করা হয়ে থাকে।

স্বাভাবিক পূজা-পার্বণ অনুসারে এবং তন্ত্র পূজা অথবা তন্ত্র সাধনা অনুসারে আপনি কিন্তু সহজেই বাড়িতে স্বাভাবিক নিয়মে মা কালীর পূজা করতে পারেন। আর যদি মনে করেন যে তন্ত্রসাধনার মধ্যে দিয়ে মা কালীকে আরাধনা করবেন তাহলে নিজে থেকেই পূজা করতে যাবেন না, অবশ্যই এই পূজাতে অভিজ্ঞতা রাখেন কোন গুরুর তত্ত্বাবধানে এই পূজা করা উচিত, না হলে পূজার বিপরীত প্রভাব পড়তে পারে আপনার এবং আপনার পরিবারের সকলের উপরে।

লাল অথবা গোলাপি রঙের কাপড় পড়ে দেব কালের পূজা করা উচিত। দেবীর সামনে ধূপ জ্বালাতে হবে, প্রদীপ জ্বালাতে হবে এবং পূজায় লাল জবা ফুল অবশ্যই অর্পণ করতে হবে। মা কালীর আরাধনায় লাল অথবা কালো বস্তুর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, তাই তার পূজায় প্রসাদ হিসেবে এই রঙের গুরুত্ব অপরিসীম। মনে রাখবেন দেবী কালীর পূজা তখনই সমৃদ্ধ হয় এবং সম্পন্ন হয় যখন তাকে সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পূজা করা হয়। দেবী কালীর আরাধোনায় লাল কুমকুম অথবা সিঁদুর, অক্ষত, লাল জবাফুল এবং ভোগে দুধ দিয়ে তৈরি মিষ্টি বা হালুয়া ছাড়া আর কিছুই দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করা হয়।

কিভাবে করবেন মা কালীর পূজা?

যদি নিজে থেকেই এই পূজা সাধারণ নিয়ম মেনে পালন করেন তাহলে আপনাকে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করে এই পূজা সম্পন্ন করতে হবে। কালী পূজা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে বিধি মেনে পালন করতে হয় এবং সাধারণত ধ্যান, দেবীর আবাহন, পুষ্পাঞ্জলি দ্বারা এই পূজার বিধি সম্পন্ন হয় বলে জানা যায়।

  • প্রথমে দেবীর ধ্যান করতে হবে, দেবী ভগবতীর মূর্তি বা লেখনি দোয়াত ঠিকমতো প্রতিস্থাপন করা হলে ধ্যান দিয়ে এই পূজা শুরু করতে হবে।
  • আবাহন হল পরের পূজা নিয়ম, ধ্যান সম্পন্ন হয়ে গেলে দেবী ভগবতী বা দেবী কালীর আবাহন করতে হয় এক্ষেত্রে হাতের একটি বিশেষ মুদ্রা এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবীর আবাহন করা হয়ে থাকে।
  • এরপর আসে পুষ্পাঞ্জলি, পুষ্পাঞ্জলী তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। প্রথমত ধ্যান এবং আবাহন দ্বারা দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেলে দেবী কালীকে সন্তুষ্ট করার জন্য পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হয়। এখানে পাঁচটি লাল জবা ফুল দেবীর চরণে অর্পণ করা হয় এবং বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করার মধ্যে দিয়ে এই ফুল দেবীর পায়ে অর্পণ করা হয়। এরপর একে একে চন্দন বাটা, ফুল, প্রদীপ, ধুপ ও নৈবেদ্য দিয়ে দেবীর বন্দনা করতে হয়।

কালীপূজাতে খিচুড়ি প্রসাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশিরভাগ জায়গায় এই খিচুড়ি প্রসাদ দেওয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু জায়গায় লুচি তরকারির ব্যবস্থা করা হয়। ভোগ হিসেবে বিভিন্ন ফল মূলত থাকছেই তার সাথে থাকছে চিড়ে, মুড়কি, যা পূজার পরের দিন সকালে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং এই প্রসাদ নেওয়ার জন্য সকলে খুবই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।

কালী পূজার উপবাস পালন:

অমাবস্যার দিনে কালীপূজা হয় তাই এই সময় বিশেষ কিছু নিয়ম মানতে হয়। উপবাস থেকে অনেকেই এই পূজার ব্রত পালন করেন, উপবাস থেকে যথাযথভাবে এই উপবাস না পালন করতে পারলে কিন্তু সুফল পেতে পারবেন না। শাস্ত্র ও নিয়ম মেনে সঠিকভাবে উপোস করলে মাঙ্গলিক দোষও কেটে যায়। এক্ষেত্রে যাঁরা কালী পূজার উপোস করবেন তাঁদের পরিষ্কার জামা কাপড় পরে এই উপবাস পালন করা উচিত।

কালী পূজার সময় অন্তত লাল বা সবুজ অথবা নীল পোশাক পরতে পারেন। যে ব্যক্তি উপবাসের ব্রত পালন করছেন তাঁকে নিজের ইষ্ট দেবকে স্মরণ করতে হবে এবং মা কালীর জপ করতে হবে। উপবাসের সময় দেবীর বৈদিক মন্ত্র জপ করতে হবে এক্ষেত্রে লঘু মন্ত্র থেকে বৈদিক মন্ত্র জপ করা বেশি শুভ ফল দেয়। এমন অনেকেই রয়েছেন যে সারাদিন উপবাস করার ফলে ঘুমিয়ে পড়েন তবে এটা কিন্তু একেবারেই উচিত নয়। উপবাস থেকে ঘুমানো ভালো লক্ষণ নয়, নিজেকে কাজ কর্মের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে।

এর পাশাপাশি কোন খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, নেশা জাতীয় দ্রব্য নেওয়া চলবে না, সারাদিন উপবাস রাখতে পারছেন না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চারা জল ও ফল খেতে পারেন, এসময় মিথ্যা কথা বলা একেবারেই উচিত নয়। উপবাস চলাকালীন বাড়িতে ধুনোর গন্ধ যেন বরাবরই থাকে। গরিবদের মধ্যে দান করতে পারেন, উপবাসে দুদিন আগে থেকেই নিরামিষ খাবার গ্রহণ করতে হবে। এর সাথে সাথে মহাদেবের আরাধনা করতে পারলে খুবই ভালো। আর বেল পাতার মসৃণ দিকটা শিবের মাথায় দিয়ে পূজা করতে পারেন। তাছাড়া ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে পারেন আপনার সাধ্যমত। এই সময় মহান মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে পারেন এতে সংসারে মঙ্গল সাধন হয়।

মা কালীকে খুশি করবেন যেভাবে:

পরিবারের কোনো সদস্য যদি গভীর অসুখের পড়ে থাকেন তাহলে মা কালীর চরণে সাদা আবির নিবেদন করতে পারেন। আর এটি করলে মা কালীর আশীর্বাদ খুবই তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর পূজা ও মঙ্গলবারে কালী মন্দিরে গিয়ে তার বীজ মন্ত্র জপ করতে পারেন এবং তিন মালা মন্ত্র জপ করতে পারেন এক মালা অর্থাৎ ১০৮ বার। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি অমাবস্যার রাতে কালী পূজা করা হয় সে ক্ষেত্রে মা কালীকে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উৎসর্গ করা হয় তাকে খুশি করতে। এছাড়াও লুচি প্রসাদ এবং নানা ফল হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থের বাড়িতে সাধারণত তান্ত্রিক কালী পূজা হয়না, এখানে অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পূজা দেখা যায়।

জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট থেকে সরে আসতে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে আর সংসারে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বজায় রাখতে মহাকালীর পূজায় অংশগ্রহণ করে থাকেন অনেকে। সারা বছর ধরে এই পূজার অপেক্ষা করা হয়, মা কালীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তিনি ভক্তদের উপরে আশীর্বাদ বর্ষণ করেন আর পূজা মন্ডপ হোক অথবা বনেদি বাড়ি সব জায়গাতেই মা কালীর পূজা উপলক্ষে খিচুড়ি ভোগ অথবা লুচি ভোগ এর সাথে সাথে ছাগল বলি দেওয়া হয়। যা ভোগ অথবা নৈবেদ্য হিসেবে মাকে অর্পণ করার পরে তা প্রসাদ হিসেবে সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অন্ধকার কাটিয়ে আলো নিয়ে আসেন মা কালী, অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তির সঞ্চার ঘটান তিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!