Worldwide Bengali Panjika

যমপুকুর ব্রত পূজা ও বিধি- Jampukur Vrat


যমপুকুর ব্রত (Jampukur Vrat): হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যমরাজ (Yamraj) কে অবশ্যই চিনবেন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করতে এবং মৃত্যুর দেবতাকে (God of Death) পূজা করার জন্য মুখিয়ে থাকেন প্রায় সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে এই যমরাজ কে নিয়ে যেমন ভয় রয়েছে তেমনি তাঁর পূজা করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

সে ক্ষেত্রে গ্রাম বাংলায় এখনো পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে যমপুকুর ব্রত (Jampukur Vrat)। এই ব্রত পালনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চার বছর এই ব্রত পালন করতে হয় এবং লাস্টের বছর অর্থাৎ চতুর্থ বছরে ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর নিয়ম রয়েছে।

যমপুকুর ব্রত পালন:

গ্রামবাংলায় এমন অনেক ছোটখাটো ব্রত পালন করে থাকেন সেখানকার হিন্দু মহিলারা। যম পুকুর ব্রত উদযাপন করার ক্ষেত্রে অবিবাহিত হিন্দু মহিলারাই অগ্রাধিকার পান। অর্থাৎ বলা যায় যে শুধুমাত্র অবিবাহিত হিন্দু মহিলারা এই ব্রত পালন করে থাকেন। সম্পূর্ণ কার্তিক মাস জুড়ে এই ব্রত পালন করা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী চার বছর ধরে এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রতের উদ্দেশ্য হল পরলোক গমন করেছে এমন প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনরা যেন উদ্ধার পেয়ে যান, শান্তি পান এবং নরক যন্ত্রণা ভোগ না করে স্বর্গবাসী হন। সে ক্ষেত্রে এই প্রার্থনা করা হয় এই ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে।

যমপুকুর ব্রতর ব্রতকথা:

বাড়ির উঠানে অথবা মেঝেতে আল দিয়ে অথবা পুকুর পাড়ে এই ব্রত পালন করতে হয়। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে এক ব্রাহ্মণী ছিলেন, তাঁর একটি পুত্র এবং একটি কন্যা সন্তান ছিল। কন্যার সাথে বিয়ে হয় যমরাজের, কন্যার বিবাহের পর ব্রাহ্মণের খুব মন খারাপ হয়ে যেতে থাকে। বাড়িতে তিনি কন্যার অভাব পূরণ করতে ছেলের বিয়ে দেন এবং ছেলের বউ নিয়ে আসেন মেয়ে হিসাবে। ছেলের বউ নিজের গুণ দিয়ে সকলের মন জয় করে নেন। কার্তিক মাস শুরু হতেই উঠোনে খুঁড়ে সে যমপুকুর ব্রত আরম্ভ করে।

তাই দেখে তাঁর শাশুড়ির মনে হয় ছেলের বউ তাঁকে কোনরকম জাদু-টোনা অথবা তুকতাক করছে। উঠোনের যমপুকুর শাশুড়ি বন্ধ করে দেন। এসব দেখে ছেলের বউ যমরাজকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন- “আমি তোমার উদ্দেশ্যে যমপুকুর ব্রত করলাম, আমার এক বছর হল এরপরে তিন বছরে একইভাবে শাশুড়ি চোখের আড়ালে এই ব্রত সম্পন্ন করতে চাই।” তাঁর ছেলের বউ কিন্তু প্রতিবারই ধরা পড়ে যায় প্রতিবারই তাঁর শাশুড়ি যম পুকুর টি মাটি ফেলে বন্ধ করে দেন এবং তাঁর ছেলের বউ যমরাজের উদ্দেশ্যে জমপুকুর ব্রত সম্পন্ন হওয়ার কথা বলেন।

এইভাবে চলতে চলতে চার বছর ধরে ছেলের বউ যমপুকুর ব্রত সম্পন্ন করেন। এরপর অসুস্থতার কারণে তাঁর শাশুড়ি মারা যান। শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য যমরাজের স্ত্রী অর্থাৎ ব্রাহ্মণের মেয়ে তখন বাপের বাড়ি যান এবং কাজকর্ম সেরে পুনরায় যমরাজের কাছে ফিরে আসেন। যমরাজ তখন তাঁর স্ত্রীকে বলেন- “কখনো যমলোকের দক্ষিণ দিকে যাবে না”। কিন্তু যেখানে যেতে বারণ সেই জায়গাটাতেই তো বেশি কৌতুহল জাগে তাই না! কৌতূহলী হয়ে যমরাজের স্ত্রী ভাবলেন কি আছে দক্ষিণ দিকে আমাকে দেখতেই হবে। দক্ষিণ দিকে যেতেই দেখলেন তাঁর নিজের মা তখন নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন, যমরাজের স্ত্রী তখন ছুটে গিয়ে যমরাজের কাছে তাঁর নিজের মায়ের উদ্ধারের কথা বলেন।

যমরাজ তখন বলেন- “যে ছেলের বউকে তোমার মা এত কষ্ট দিয়েছে সে যদি তোমার মায়ের উদ্দেশ্যে যমপুকুর ব্রত উদযাপন করেন, তবেই তোমার মা উদ্ধার পাবেন। কিন্তু সে কি রাজি হবে?” যম এ কথা বলার পরেই তাঁর স্ত্রী ছুটে গেল বাপের বাড়ি। তখন দেখল তাঁর ভাইয়ের বউ প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করছেন কিন্তু বাচ্চা প্রসব হচ্ছে না।

যমের স্ত্রী তাঁকে বলল শাশুড়ির উদ্দেশ্যে যমপুকুর ব্রত উদযাপন করলেই সন্তান ভুমিষ্ট হবে। তখন তাঁর ভাইয়ের বউ যমপুকুর ব্রত সম্পন্ন করলেন, তাঁর গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো এবং শাশুড়ি ও নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উদ্ধার পেলেন।

যমপুকুর ব্রত পালনের নিয়ম:

প্রথমে এই ব্রত পালনের উপকরণ হিসেবে :-

  • ধান,
  • কলা,
  • হলুদ,
  • কলমি শাক,
  • মান কচু,
  • শুশনি শাক ও
  • হিঞ্চে শাকের চারা গাছ,
  • সুপুরি,
  • কয়েকটি কড়ি এবং
  • কয়েকটি মাটির মূর্তি সংগ্রহ করতে হবে।

যমের পূজা পদ্ধতি:

  • এরপরে চারটি ঘাট সহ চৌক আকারে একটি পুকুর কাটতে হবে, যার পরিমাপ হবে এক হাত × একহাত ক্ষেত্রফল।
  • আর সেটি জলপূর্ণ করে দক্ষিণ দিকের ঘাটে আলপনার উপর মাটির যমরাজ যমরানি ও যমের পিসির মূর্তি স্থাপন করতে হয়।
  • উত্তর দিকের ঘাটে মেছো ও মেছনি,
  • পূর্ব দিকের ঘাটে ধোপা ও ধোপানি,
  • পশ্চিম দিকের ঘাটে মাটির কাক, বক, চিল, কচ্ছপ, কুমির, হাঙ্গর ইত্যাদির মাটির মূর্তি তৈরি করে রাখতে হয়।
  • পুকুরের মাঝখানে এক গোছা ধান, কলমি শাক, শুষনি শাক ও হিঞ্চে গাছ পুঁততে হয়।
  • কচু গাছ, হলুদ গাছ প্রভৃতি গাছ পাড়ে থাকতে হবে।
  • পুজোর সময় পুকুরের চার কোণে চার কড়া কড়ি, ৪ টি হলুদ ও সুপারি পুতে দিয়ে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে হবে।
  • তারপর পূর্ব দিকে মুখ করে বসে ফুল সহযোগে যমের পুজো করতে হবে।
  • পুকুরে জল দেওয়ার, গাছে জল ঢালার এবং মূর্তিগুলি পূজা করার আলাদা আলাদা মন্ত্র রয়েছে, পূজার সময় সেগুলি উচ্চারণ করতে হবে।

এছাড়া প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পূজা শেষ করার পরও যে কথাগুলি বলতে হয় সেটা হল:-

“সাত ভাইয়ের বোন, আমি ভাগ্যবতী, যম পুকুর পূজি আমি, সাক্ষী জগৎপতি।” এছাড়া যদি কেউ এই ব্রত প্রথমবার পালন করে থাকেন তাহলে পরপর চার বছর এই ব্রত পালন করতে হবে। চতুর্থতম বছরে ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর নিয়ম রয়েছে এবং গ্রামবাংলায় এই ব্রত আজও পালিত হয় সমস্ত নিয়ম রীতি মেনেই।

যমরাজকে মৃত্যুর দেবতা বলে সবাই জানেন, যমের নাম শুনলেই সকলের মনে এক ভয় কাজ করে এবং যমের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই অনেক রকম পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন এবং পূজা-অর্চনা করে থাকেন। এই পূজার মধ্যে দিয়ে যেমন যমের সু-নজরে থাকা যায় তেমনি অকাল মৃত্যুর হাত থেকেও বাঁচা যায়।

যমের ভয় থেকে মুক্তি পেতে এবং অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচতে যে কাজগুলি করতে পারেন:

১) খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পবিত্র হয়ে সূর্যকে জলের অর্ঘ্য দেওয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। সূর্য উদয়ের আগে উঠে এই কাজ করতে হবে। সূর্যকে জল অর্পণ করলে আত্মবিশ্বাস, জোশ, তেজ, সাহস, ইতিবাচকতা ও সুখ বৃদ্ধি পায় বলে জানা যায়।

২) তাছাড়া তামার ঘটিতে করে জল ভরে তাতে কুমকুম, লাল ফুল, অক্ষত দিয়ে সূর্যকে অর্পণ করা হয় জল যা শুভ ফল দায়ী।

৩) নিজের সাত পুরুষের উদ্ধার করার জন্য সূর্য মন্দিরে ঝাড়-পোছ করলে বিশেষ ফল লাভ করা যায় বলে জানা যায়।

৪) যমদূতের ভয় থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন সূর্য মন্ত্র জপ করা উচিত, সূর্য মন্ত্র জপ করলে কোষ্টিতে সূর্যের পরিস্থিতি মজবুত হয়।

৫) যমরাজের সুনজরে থাকার জন্য সূর্যকে দুধ ও ঘি অর্পণ করলে শুভফল লাভ করতে পারবেন।

৬) অকাল মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতি মাসের অমাবস্যায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে গীতার সপ্তম অধ্যায় পাঠ করা খুবই শুভ অথবা শ্রবণ করা খুবই শুভ।

৭) জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে এই সপ্তম অধ্যায় পাঠ সমাপ্ত হওয়ার পর সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করুন। পরিবারের সদস্যরা মিলে উন্নত স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকেন সূর্য দেবতার কাছে।

৮) এছাড়া অমাবস্যার সময় দরিদ্র ও অসহায় বাচ্চাদের খাবার দান করতে পারেন, তার পাশাপাশি মিষ্টি হালুয়া খাওয়ালে শুভ ফল লাভ করতে পারবেন।

প্রতিটি পূজা অর্চনার মতো এই যমপুকুর ব্রত পালনে বিশেষ শুভ ফল লাভ করার পাশাপাশি গ্রাম বাংলার মা ও বোনেদের এই ব্রত এক আনন্দের উৎসব। এই উৎসবে বাড়ির সকল সদস্যরাই একসাথে মিলে উৎসব উদযাপন করে থাকেন। প্রথা চলতে চলতে আজ এই ব্রত এক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!