Worldwide Bengali Panjika

গুহ্য কালী পূজা – Guhya Kali Puja


গুহ্য কালী পূজা (Guhya Kali Puja): হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে মা কালী কে চেনেন না এমন হিন্দু পাওয়া যাবে না বললেই চলে। তবে মা কালীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে এটি হলো একটি অন্যতম রূপ। তবে এই রূপ ভীষণ ভয়ঙ্কর। কোন কোন সাধক এই রূপের আরাধনা করে থাকেন তবে গৃহস্থের বাড়িতে এই রূপ কোন ভাবে পূজা পায় না। গুহ্য কালীর এক অতি ভয়ংকরী রূপ হলো এটি। এই রূপ কালির প্রচলিত রূপের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। গুহ্য কালী দিভূজা, সর্পভূষিতা ও খড়গহস্তা। এই দেবীকে সূর্যকালী অথবা আকালী কালী নামেও অনেকেই চিনে থাকবেন।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

বীরভূম জেলার আকালিপুর গ্রামে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে শ্মশানের পাশে মহারাজা নন্দকুমার একটি গুহ্য কালী মন্দির নির্মাণ করেন। তবে এই বিচিত্র কালী মূর্তিটি তাঁর দ্বারা নির্মাণ করা হয়নি। লোকো মুখে শোনা এবং পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় মগধরাজ জরাসন্ধ এই কালী মূর্তি নির্মাণ করেছেন। কালক্রমে বিভিন্ন রাজার হাতে পুজিত হওয়ার পর কাশি রাজ চৈত সিংহের রাজ্যের এক কৃষক তাঁর জমিতে এই মূর্তিকে খুঁজে পান। এই খবর পাওয়া মাত্র রাজা চৈত সিংহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবী গুহ্য কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের দক্ষিণে পঞ্চ মন্দির নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে।

আকালিপুরের দেবী গুহ্যকালী কে ভক্তেরা অতিশয় জাগ্রত দেবী বলে মনে করেন। দূর দূরান্তর থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে মানসিক (মানত) করে পূজা দিতে আসেন। দেবী গুহ্য কালীর বিশেষ গোপনীয়তা বজায় রেখে সমস্ত আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। দেবীর এই মন্দিরটি ইটের তৈরি আট কোনা এবং দক্ষিণমুখী মন্দিরের গর্ভ গৃহের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার জন্য পথ রয়েছে। মোট তিনটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে মন্দিরের ভিতরে, যেগুলি পাথর দিয়ে তৈরি। কথিত আছে এই মন্দির তৈরীর সময় দেয়ালে ফাটল ধরেছিল। পরে তা মেরামত করতে গেলে দেবী স্বপ্নে দেখা দেন এবং নির্দেশ দেন যে তার মন্দিরের প্রয়োজন নেই। দেবীর সেই নির্দেশ স্বরূপ এখনো মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে দুটি ফাটল দেখা যায়। প্রতিবছর কালীপুজোর সময় এখানে খুবই সমারোহ এর সাথে এই দেবীর পূজা করা হয় না, আর এই দেবীর নিত্য পূজায় অংশগ্রহণ করতে দূর দূরান্তর থেকে অনেক ভক্তরা ছুটে আসেন।

গুহ্য কালীর স্বরূপ অথবা মূর্তি:

প্রতিটি দেবদেবীর একটি নিজস্ব আকার এবং রূপ থাকে সেই অনুযায়ী সেই দেব-দেবীকে চেনা যায়।তেমনি গুহ্য কালীরও একটি রূপ রয়েছে যা খুবই ভয়ঙ্কর। দেবী গুহ্য কালীর যে মূর্তিটি বর্ণিত হয়েছে সেই অনুসারে জানা যায় গুহ্য কালীর গায়ের বর্ণ গাঢ় মেঘের মতো, তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা। গলায় পঞ্চাশটি নরমূলের মালা, কোটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণ বস্ত্র, কাঁধে নাগ যজ্ঞপবিত, মাথায় জটা এবং অর্ধচন্দ্র, কানে আছে শব দেহরূপী অলংকার, মুখে হাসি রয়েছে, চতুর্দিকে না-ফনা দ্বারা বেষ্টিত ও নাগ আসনে উপবিষ্টা।

বাম হাতের কঙ্কনে তক্ষক সর্পরাজ ও ডান হাতের কঙ্কনে অনন্ত নাগরাজ। বামদিকে বৎসরূপী শিব, তিনি নবরত্ন ভূষিতা। তিনি অট্টহাস্যকারিণী মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফল প্রদায়িনী। এছাড়া এই দেবী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।

বীরভূমের গুহ্য কালীর এই মন্দিরটি দেখতে অপরূপ সুন্দর, গায়ে শিহরণ জাগানো পরিবেশ, সম্পূর্ণ পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি মন্দিরের মাথার অংশ ত্রিভুজ আকৃতির এবং এর গায়ে নকশা করা রয়েছে। এর ভেতরের দেয়ালে ও নানা ধরনের নকশা আঁকা রয়েছে, আর বহু দেবদেবীর ছবিও রয়েছে। মন্দিরের ভিতরে মহাকালীর মূর্তি বর্তমান যিনি গুহ্য কালী ও আকালি রূপে পূজিত হন।

গুহ্য কালীর পূজা:

কালীমন্দিরে কালী পূজার রাতে বিশেষভাবে পূজিত হন না প্রতিমা। এমন কথা শুনলে হয়তো অবাক হবেন, তাই না ! তবে এমনটাই ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের গুহ্য কালীমন্দিরে (Guhya Kali Temple)। শুধু তাই নয় প্রতি রাতে এবং বিশেষ করে কালীপুজোর রাতে মন্দির থাকে একেবারে সুনশান, ভক্ত শুন্য। এমনকি দেবী নিজেও গর্ভ গৃহ থেকে বেরিয়ে আসেন বলে দাবি করেন এলাকার মানুষজন। তাঁদের কথায় কালীপুজোর রাতে দেবী মেতে ওঠেন নৈশ লীলায়, ঘুরে বেড়ান গোটা গ্রাম। কথিত আছে রাতভর শোনা যায় মায়ের পায়ের নুপুরের শব্দ। স্থানীয়দের দাবি অনুসারে এক সময়ে যে মন্দিরে নরবলি ও শিশু বলি দেওয়া হত সেই মন্দিরের মা তো জাগ্রত হবেনই, এতে আর নতুন কি !

তবে এই দেবীর পূজা করতেন মগধরাজ, পরবর্তীতে এই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন পাশের রাজা চৈত্র সিং। তবে ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস যখন রাজা চৈত সিংহের প্রাসাদ লুঠ করেন তখন তিনি অনেক সম্পদ সহ দেবীর এই মূর্তিটিও লুঠ করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। এরপর গঙ্গা বক্ষে কলকাতা যাত্রা করার পথে রাজা নন্দকুমার এই মূর্তিটি উদ্ধার করেন এবং ব্রাহ্মণীপুর নদীর ধারে এই দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো শুরু হয় দেবীর মন্দিরের নির্মাণের কাজ কিন্তু আচমকা বজ্রপাতের ফলে মন্দিরের কোনগুলি ভেঙে পড়ে ফলে শেষ হয় না মন্দিরের চূড়া তৈরির কাজ। ইতিমধ্যে রাজা নন্দকুমারকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেন হেস্টিংস এবং রাজার অকাল মৃত্যু ঘটে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মৎস্য মন্ত্রী কিরণময় নন্দ ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে মন্দিরের পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেন।

জাগ্রত মা গুহ্য কালীর একটি অলৌকিক ঘটনা:

বর্তমানে মন্দিরটি দেখতে অবিকল কোনো পোড়ো বাড়ির মত। সন্ধের পর মন্দির চত্বরে গেলে গা ছমছম করার মত একটা অনুভূতি হয়। এলাকাবাসী এই দেবীর নাম দিয়েছেন আকালি কালী। এছাড়াও এই দেবী মূর্তি নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। জানা যায়, দেবীকে সন্তুষ্ট করতেই মায়ের উদ্দেশ্যে এক শিশুকে পাশের গ্রাম থেকে তুলে এনে নরবলি দেওয়া হয় এবং শিশুটির মা পরে তাকে খুঁজতে খুঁজতে এই দেবী মূর্তির কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানাতে দেখা যায় পাশের নদী থেকে সুস্থ শরীরে শিশুটি ফিরে আসে তার মায়ের কাছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এই অলৌকিক ঘটনা এবং ভক্তরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে কোন মনস্কামনা নিয়ে আকালি মায়ের পুজো দিলে তা অবশ্যই সফল হয় এবং অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে।

পূজা বলতে গেলে প্রতিদিন নিত্য পূজা হয় এই দেবীর। সন্ধ্যা আরতির পর মায়ের শয়ন দেওয়া হয়। কথিত আছে গভীর রাতে মা গর্ভ গৃহ থেকে বেরিয়ে পড়েন নৈশ লীলা করতে। এই কথাটা শুনতে অবাক লাগবে যে কার্তিক মাসের কালীপুজোর অমাবস্যা তিথিতে সব জায়গায় কালী পূজা হলেও আকালী মায়ের বিশেষ কোনো পূজা হয় না এই তিথিতে। কারণ লোকোমুখে শোনা কথা অনুসারে, যে কালী পূজার রাতে মা গর্ভগৃহেই থাকেন না সেই মায়ের কিভাবে পূজা দেওয়া যেতে পারে ! ভক্ত সমাগম হলে মায়ের নৈশলীলায় বাধা পড়বে এমনটা ভেবে নিত্য পূজো ছাড়া কোন বিশেষ পুজো করা হয় না এই মন্দিরে।

তবে দেবীর পূজা অর্চনা বলতে গেলে দুর্গাপূজার পর চতুর্দশীর দিন ও পৌষ সংক্রান্তির দিন বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। আকালি মায়ের মন্দিরে এই সময়ে ভক্তরা ভিড় করেন মন্দির চত্বরে। ভক্তদের বিশ্বাস মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রাহ্মণী নদীতে স্নান সেরে এই মন্দিরে পূজা দিলে মনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়। আর এই বিশ্বাস মেনে আজও পর্যন্ত বহুদূর থেকে ভক্তরা এখানে এসে মায়ের পূজা দিয়ে যান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!