Worldwide Bengali Panjika

ধর্মরাজ পূজা বিধি ও নিয়ম – Dharmaraj Puja


ধর্মরাজ পূজা (Dharmaraj Puja): প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে যে কোন গ্রামে সেখানকার নির্দিষ্ট গ্রাম দেবতাকে পূজা অর্চনা করে গ্রামের সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেখানকার স্থানীয় মানুষ জনরা। সেই দেবতার পূজা অর্চনা করে থাকেন নির্দিষ্ট তিথি অনুসারে এবং সেই পূজাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন বহু দূর দূরান্তর থেকে আগত অনেক ভক্তগণ। তেমনই এক দেবতা হলেন ধর্মরাজ। ধর্মরাজ হলেন গ্রাম দেবতা পশ্চিম বর্ধমান জেলার অনেক গ্রামে এই দেবতা অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এই পূজা খুবই ধুমধাম ভাবে পালন করা হয়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

গ্রাম দেবতা বলতে বোঝায় যে গ্রামদেবতা শুধুমাত্র একটি গ্রামে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং আঞ্চলিক গ্রাম দেবতা হলেন যে গ্রাম দেবতা বিভিন্ন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সেই হিসাবে ধর্মরাজকে আঞ্চলিক ও গ্রামদেবতা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। পোড়া মাটির তৈরি ঘোড়া হলো ধর্মরাজের বাহন। দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের জন্য এবং আরো অন্যান্য জটিল সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকেই এই ঘোড়া ধর্মরাজকে মানত হিসেবে দান করে থাকেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এই পূজা খুবই সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বিভিন্ন গ্রামে ধর্মরাজ পূজা সাধারণত বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে পালিত হয়ে থাকে।

বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে ধর্মরাজের পূজার বর্তমানে কোন সম্পর্ক না থাকলেও প্রাচীনকালে এই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ প্রাচীনকালে পশ্চিম বর্ধমান জেলার অরণ্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর সেই সময়কালে বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষিত হওয়া সমাজের এক শ্রেণীর মানুষেরা এই পূজার প্রচলন শুরু করেন। কিন্তু প্রথম থেকেই এই পূজার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। কারণ ওই শ্রেণীর মানুষরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও ধর্মরাজের পূজায় তারা সংযুক্ত করেছিল তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা কে।

ধর্মরাজ দেবতার মূর্তি:

ধর্মরাজের নিজস্ব কোন মূর্তি নেই বললেই চলে, শিলাকেই দেবতা হিসেবে মানা হয় এবং সেই শিলাকেই পূজা করা হয়। প্রাচীন কথা অনুসারে বহু প্রাচীনকাল আগে গ্রামের শেষ সীমানায় আঁকড়া গাছের তলায় ধর্মরাজ দেবতা অধিষ্ঠান করতেন। আর ধর্মরাজ পূজার সঙ্গে শিবের যোগসূত্র রয়েছে এমনটা বিশ্বাস করা হয়।

কারণ মন্দিরে ধর্মরাজের সঙ্গে লৌহ শলাকা যুক্ত একটি কাঠের পাঠাতন কে রাখা হয় যা বানেশ্বর নামে পরিচিত। ধর্মরাজের গ্রাম পরিক্রমা করার রীতিকে স্থানীয় ভাষায় বারাম বলা হয়। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ধর্মরাজ পূজা পালনকারী ভক্তরা, ভক্তা নামে পরিচিত।

ধর্মরাজ পূজা বুদ্ধ পূর্ণিমার (Buddha Purnima) দিনে অনুষ্ঠিত হলেও এই পূজা সম্পন্ন হতে সময় লাগে তিন দিন। কোথাও কোথাও এই পূজার সম্পন্ন হয় চার – পাঁচ দিন ধরে।

ধর্মরাজ পূজার কিছু কথা:

এই পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই ভক্তরা উপবাস করতে শুরু করেন। ভক্তদের লোটন, কাঁটা, দন্ডী দেওয়া, দেহের বিভিন্ন অংশ ছুঁচ অথবা কাঁটা দিয়ে কেটে রক্ত দেওয়া যা বান্ছড়া নামে পরিচিত। যেটা ধর্মরাজ পূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। ধর্মরাজের বিভিন্ন নাম রয়েছে, কোন গ্রামে ধর্মরাজ দেবতা কালা রায় নামে পরিচিত।

পূজার অংশ হিসাবে মন্দির প্রাঙ্গণে ভূমিতে স্বয়ং অবস্থায় তাঁরা বাবা ধর্মরাজের আরাধনা করেন যা পাতাভরা অনুষ্ঠান নামে পরিচিত। পুজোর দ্বিতীয় দিনে মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার জন্য মহিলারা কলসি ভর্তি জল নিয়ে পুকুরে যান ফেরার পথে পুরুষ ও মহিলা সকলেরই দন্ডী দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া পাতাভরা, কাঁটাখেলা, ফুলখেলা, শিবদোলা, বানফোঁড়া, নানান ধরনের অনুষ্ঠান দ্বিতীয় দিনে সম্পন্ন করা হয়। তৃতীয় দিনের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাঁঠাবলি। আর চতুর্থ দিনে পুজোর শেষ দিন যেটা বলা হয় সেই দিনে তেল হলুদ জিলিপি ইত্যাদি সমস্ত ভক্তদের দেওয়ার রীতি রয়েছে। যাকে স্থানীয় ভাষায় উথুরিখোলা বলা হয়।

ধর্মরাজ ঠাকুরকে মূলত শিব, বিষ্ণু ও সূর্য দেবতার ধারক ও বাহক হিসেবে কল্পনা করা হয়। যদিও এই ধারণা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। ধর্মরাজ ঠাকুরের নির্দিষ্ট কোন মূর্তি হয় না। সিঁদুর মাখানো নির্দিষ্ট আকারবিহীন প্রস্তরখন্ডে ধর্মরাজের পূজা করা হয় প্রাচীনকাল থেকে। কোথাও কোথাও গাছের তলায় বা উন্মুক্ত জায়গায় রাখা হয় এই পাথর যা ধর্ম ঠাকুরের থান বা ধর্মরাজতলা বলা হয়। আবার অনেক গ্রামেই ধর্মরাজ ঠাকুরের মন্দির থাকে এবং দেবতা সেখানেই নিত্য পুজোয় পূজিত হন।

ধর্মরাজ পূজার প্রথা:

এই পূজায় অনেক ছোটখাটো আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভক্ত হওয়া। অনেকেই এই ভক্ত হওয়ার মানত অথবা মানসিক করে থাকেন। এই ভক্ত হওয়ার কাজটি খুবই কঠিন। যা সংযম এবং নিয়ম-নিষ্ঠার মধ্যে পালন করতে হয়। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে আরো অনেক প্রথা রয়েছে যেগুলি পালন করতে হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কামান বা কামানো প্রথা পালন করা। যা অনেকটাই অন্তেষ্টিক্রিয়া সৎকার্যের মতোই বলা যেতে পারে।

পূজার পাঁচ দিনের মধ্যে প্রথম তিন দিন ছোটঘাট পূজা, মেজঘাট পূজা এবং বড়ঘাট পূজা করা হয় যেখানে বানেশ্বরের পূজা করা হয় যা শিবেরই একটি রূপ। শেষের দুই দিন অনেক আচার অনুষ্ঠান থাকে যেমন ধরুন জলন্ত অঙ্গারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ভক্তগণ দের পিঠের উপর দিয়ে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া, মাথায় হাঁড়ি নিয়ে যাওয়া, কারো মধ্যে ভর আসা, কেউ বুকে কাঁটা অথবা ছুরি দিয়ে কেটে রক্ত দেন। এছাড়া গাজন অথবা চড়কের সাথে এর অনেক মিল রয়েছে, অনেকেই মানত করে উঁচু জায়গা থেকে ঝাঁপ দেন।

ধর্মরাজ পূজার তাৎপর্য:

ধর্ম ঠাকুর নিম্ন জাতির পূজ্য দেবতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের ডোম, বাগধি, আদিবাসী, হাঁড়ি, প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরাই বিশেষভাবে এই দেবতার উপাসক। তিনি রোগ নিরাময় করেন, ভক্তকে সন্তানের বরদান করেন এবং ধারণা করা হয় যে তাঁর উপাসকদের মধ্যে তিনি আশীর্বাদ প্রদান করেন।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের রঞ্জাবতী তাঁর পূজা করে বীরপুত্র লাউসেনকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। ধর্ম ঠাকুর শুভ্র নিরঞ্জন, আদিম মানুষদের বিশ্বাস সূর্যের রং সাদা এবং তার বাহন ঘোড়ায় টানা রথ। এই থেকে সূর্যের প্রতি ধর্ম কেও মনে করা হয় শুভ্র এবং তাঁর পূজার সময় তাঁকে কাঠের ঘোড়ায় চড়ানো হয়।

ধর্ম ঠাকুরের বাহন সাদা ঘোড়া এবং সাদা ফুল তাঁর খুবই প্রিয়। তাঁর আসল প্রতীক পাদুকা, ধর্ম পূজার সময় পুরোহিতরা গলায় এক খন্ড পাদুকা বা পাদুকার মালা পরিধান করে থাকেন। এই পূজার প্রধান পুরোহিত হচ্ছে ডোম। তবে কৈবর্ত, শুঁড়ি, বাগদী ও ধোপাদের ভিতর থেকেও আজকাল ধর্ম পণ্ডিত বা পুরোহিত হতে দেখা যায়। বর্তমানে কোথাও কোথাও ধর্ম ঠাকুর শিব অথবা বিষ্ণুর সঙ্গে একীভূত হয়ে পূজা পেয়ে থাকেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!