Worldwide Bengali Panjika

চিত্রগুপ্তের পূজা বিধি ও নিয়ম – Chitragupta Puja


চিত্রগুপ্তের পূজা (Chitragupta Puja): হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বারো মাসে তেরো পার্বণের পাশাপাশি একদিনে আরও অনেকটা পূজা পার্বণের কথা বলা হয়। অর্থাৎ একটি তিথিতে দু তিনটি পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

ভাইফোঁটার (Bhai Phonta) কথা আমরা তো সকলেই জানি, দীপাবলি (Deepawali) অর্থাৎ কালী পূজার (Kali Puja) দুদিন পরেই এই অনুষ্ঠান প্রতিটি ঘরে ঘরে ফিরে ফিরে আসে। আর বোনেরা তাঁদের ভাইদের দীর্ঘায়ু কামনা করতে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করতে জীবনে উন্নতি সাধন করতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করে থাকেন।

ভবিষ্য পুরানে এই শুভ দিন অর্থাৎ যমদ্বিতিয়া বা ভাইফোঁটার দিন বোনেদের রাঁধা ভাত খাওয়ার বিধান রয়েছে। তাহলেই ভাইয়ের আয়ু, যশ বাড়বে সর্ব সিদ্ধিও ঘটবে। তবে এই বিষয়টা এখানেই শেষ হয়নি। পাঁজি অর্থাৎ পঞ্জিকা অনুসারে এই শুভ দিনে যমের পূজার (Yama Puja) সঙ্গে যমের বিশেষ সহায়ক কলমচি চিত্রগুপ্তের পূজার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

চিত্রগুপ্তের পূজার প্রচলন:

প্রতিটি পূজা কোন না কোন এক সময় থেকে শুরু হয়েছে। তেমনি চিত্রগুপ্তের পূজার প্রচলন ১১৫ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ ভূপালচন্দ্র সরকার চিত্রগুপ্ত পূজা চালু করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, চিত্রগুপ্তকে সন্তুষ্ট করতে পারলে ভাইয়েরা অমরত্ব লাভ করবেন এবং স্বর্গ নরকের এই যে হিসাব তা সঠিকভাবে করে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে পারবেন সকলকে।

যমের হিসাব রক্ষক ছিলেন চিত্রগুপ্ত (Chitragupta), আর তিনি ছিলেন কায়স্থ আর যাঁরা কায়স্থ তাঁদের কাছে তিনি হলেন আদি পিতা, পূর্বপুরুষ হিসেবে তাই চিত্রগুপ্তকে পূজা করা হয়ে থাকে। কায়স্থ সম্প্রদায়ের পূজা হলো এটি।

চিত্রগুপ্তের পূজা:

যম রাজের সঙ্গে চিত্রগুপ্তের সম্পর্ক একেবারে যে একনিষ্ঠ তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি মানুষের পাপ পুণ্যের হিসাব রাখেন আর সেই অনুযায়ী যমরাজ (Yamraj) সেই মানুষকে সেই রকমই শাস্তি প্রদান করেন।

তবে ভাই ফোঁটার দিন যমরাজকে তো অবশ্যই ভাইফোঁটার ছড়াতে স্মরণ করা হয় ঠিকই তবে এই দিন চিত্রগুপ্তকেও ফোঁটা দেওয়ার সাথে সাথে পূজা করা হয়। সব জায়গায় এই পূজার চল না থাকলেও আরামবাগের বাতানাল গ্রামের ভাইফোঁটার দিন পরম্পরা মেনে চিত্রগুপ্তের পূজা করা হয়ে থাকে।

রীতি মেনে তাঁর মূর্তির কপালে ফোঁটা দেওয়ার পরে তবেই কিন্তু এখানে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন গ্রামের সকল বোনেরা। কথিত রয়েছে চিত্রগুপ্তকে সন্তুষ্ট রাখতেই এই গ্রামে এই পূজার প্রচলন হয়েছিল। যদিও গ্রামবাসীর একাংশের দাবী কায়স্থদের আদি পিতা হওয়ায় পুজো করা হয় চিত্রগুপ্ত কে, আর এই পূজা উপলক্ষে ভিড় জমে উঠে আর আলোক মালায় সেজে ওঠে চারিদিক।

চিত্রগুপ্তের মূর্তি:

চিত্রগুপ্তের পূজা করার জন্য চিত্রগুপ্তের মূর্তির প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে চিত্রগুপ্তের মূর্তির চারটি হাত, এক হাতে রয়েছে গদা, আর এক হাতে রয়েছে তরোয়াল, বাকি দুটি হাতের দোয়াত ও কলম অর্থাৎ তিনি যে পাপ পুণ্যের হিসাব করেন সেই কারণেই তাঁর হাতে দোয়াত ও কলম সর্বদাই থাকে, চিত্রগুপ্তের বাহন এখানে মহিষ।

চিত্রগুপ্তের পূজার বিশেষ কোন নিয়ম কানুন নেই বললেই চলে। নারায়ণ মন্ত্রে পূজা হয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার স্থানীয় পুরোহিত। আমরা আগেই জেনেছি মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যাবেন স্বর্গে না নরকে তা কিন্তু নির্ভর করে চিত্রগুপ্তের লেখার উপরে, অর্থাৎ পাপ পুণ্যের হিসাব তিনিই তো করেন, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতে এবং কোনভাবে যেন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে না হয় সেই আশা রেখেই চিত্রগুপ্তের পূজার প্রচলন শুরু হয়েছে বলে জানা যায়।

চিত্রগুপ্ত পূজার প্রয়োজনীয় উপকরণ:

চিত্রগুপ্ত পূজা করতে গেলে ভক্তদের যে সমস্ত উপকরণ গুলো প্রয়োজন পড়বে সেগুলি হল:-

  • তুলসীপাতা,
  • কর্পূর,
  • কাগজ,
  • বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি,
  • কলম,
  • দোয়াত,
  • মধু,
  • হলুদ সরষে,
  • কাপড়,
  • গঙ্গাজল,
  • কালি,
  • পান,
  • গুলাল,
  • তিল,
  • ফল,
  • ফুল,
  • রোলি,
  • অক্ষত এবং
  • চন্দন।

চিত্রগুপ্তের পূজার নিয়ম বিধি:

  • চিত্রগুপ্ত পূজার জন্য সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন সেটা হল কাঠের চেয়ারে লাল বা হলুদ কাপড় বিছিয়ে দিতে হবে প্রথমত।
  • তারপর চেয়ারে চিত্রগুপ্তর মূর্তি স্থাপন করতে হবে অথবা ছবি থাকলে সেটিও রাখতে পারেন।
  • ভগবান চিত্রগুপ্ত কে ফল, ফুল, ধূপ, প্রদীপ, এবং আরো অন্যান্য যা নৈবেদ্য রয়েছে সেগুলি একে একে নিবেদন করুন।
  • পুজার জন্য নির্ধারিত যে আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয় সেগুলি নিষ্ঠা ভরে পালন করুন।
  • পুজোর সময় প্রতিমার সামনে কলম ও দোয়াত রাখতে ভুলবেন না।
  • সাদা কাগজের টুকরোতে হলুদ রাখুন এবং সেই কাগজে “শ্রী গনেশায় নম” লিখে রাখতে হবে।
  • আপনার খরচের বিবরণ সহ কাগজের নিচে আপনার নাম, ঠিকানা এবং তারিখ লিখুন।
  • পূজা শেষ হওয়ার পর কলমটি সাথে রাখুন এবং প্রয়োজন মত ব্যবহার করতে পারেন যা আপনার জীবনে সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে।

ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই চিত্রগুপ্ত পূজা:

যাঁরা ব্যবসা করেন সেই সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য বা কায়স্থ যাঁরা রয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এই পূজা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা এই শুভদিনে আপনার ব্যবসার খাতাতে ‘শ্রী’ লিখে সেটি চিত্রগুপ্তের মূর্তির সামনে রাখতে হবে। আর বিভিন্ন ধরনের লেখার কাজেও এই দিন যাঁরা যুক্ত রয়েছেন তাঁরা উপবাস পালন করে পূজা সম্পন্ন করতে পারেন। এর ফলে জীবনে উন্নতি সাধন হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা এবং যে কাজে যুক্ত রয়েছেন সেটি অনেকটাই উন্নতি সাধন করবে।

চিত্রগুপ্ত লেখালেখির কাজ করেন সে তো আমরা সকলেই জানি। এই জন্য তাঁর প্রধান কাজ হল লেখালেখি, তাই কলম ও দোয়াত এর পাশাপাশি জীবনের অনেক হিসাব এখানে যদি চিত্রগুপ্তের সামনে অর্পণ করা যায় তাহলে তাঁকে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি আপনার মৃত্যুর পরেও অনেক পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। পূজা করার ফলে শ্রী বৃদ্ধি ঘটে এবং আপনার লেখালেখিতেও অনেকটাই উন্নতি আসে, ব্যবসাতেও উন্নতি সাধন হয়।

চিত্রগুপ্তের মন্দির:

পদ্মপুরাণ অনুসারে চিত্রগুপ্ত অতি প্রাকৃত জ্ঞানের অধিকারী, গরুড় পুরানে চিত্রগুপ্তকে অক্ষর দাতা হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। এছাড়াও চিত্রগুপ্ত হলেন নবগ্রহের অন্যতম কেতু। পঞ্জিকাতে উল্লেখিত তথ্য অনুসারে ভাইফোঁটা অথবা যমদ্বিতীয়তে যমরাজের পাশাপাশি চিত্রগুপ্তের পূজারও বিধান রয়েছে।

বর্তমানে চিত্রগুপ্তের পূজা ততটা প্রচলিত না হলেও প্রাচীনকালে ভাইফোঁটার দিনে চিত্রগুপ্তের পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে এই পূজার মূল উদ্যোক্তা ছিল বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা। তার পাশাপাশি চিত্রগুপ্তকে উৎসর্গ করে অসংখ্য মন্দির কিন্তু নির্মাণ করা হয়েছে আমাদেরই ভারতবর্ষে। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহতে অবস্থিত চিত্রগুপ্ত মন্দির এবং তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে অবস্থিত চিত্রগুপ্ত মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!