বনবিবি পূজা সুন্দরবন (Bonbibi Puja Sundarban): নাম শুনলেই বোঝা যায় যে বনের দেবী তিনি, সমস্ত হিংস্র বন্যপ্রাণী থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করে থাকেন। এছাড়া সুন্দরবনের বনবিবি পূজা সেখানকার স্থানীয় মানুষজন দের কাছে খুবই ঐতিহ্য পূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলে বিভিন্ন রকমের জীবজন্তুর পাশাপাশি মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক কিছুই পাওয়া যায়। যেমন ধরুন মধু, শুকনো কাঠ, এবং গাছের ডালপালা, ফল, ফুল ইত্যাদি আরো অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
সুন্দরবন অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দারা এই জঙ্গলের উপরে নির্ভর করে বেঁচে রয়েছেন এবং নদীতে মাছ ধরে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তবে সে ক্ষেত্রে হিংস্র জীবজন্তু যেমন ধরুন এখানে বাঘের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা বনবিবি দেবীকে পূজা করে থাকেন। বিভিন্ন জায়গায় বনবিবির মন্দির রয়েছে এবং সেখানে পূজা-অর্চনাও করা হয়।
বনবিবি পূজা (Bonbibi Puja) প্রাচীনকাল থেকে চলে আসতে আসতে এখন এটি একটি লোকসংস্কৃতি তে পরিণত হয়েছে। কত মানুষের প্রাণ বাঘের আঘাতে গিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। তবে জঙ্গলে নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রবেশ তো করতে হয়, আর সেই কারণে নদী-নালাতে মাছ ধরার সময় হোক অথবা অন্য কোন কাজের ক্ষেত্রে সকলকে রক্ষা করার জন্য বন বিবিকে আরাধনা করে থাকেন এখানকার মানুষ।
বনবিবি পূজা (Bonbibi Puja):
বিভিন্ন জায়গায় মন্দির যেমন রয়েছে তেমনি পূজা মন্ডপ তৈরি করেও বনবিবি প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বনবিবির পূজা করা হয়। পূজা মন্ডপে বন বিবির প্রতিমার সঙ্গে থাকে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলি, স্থানীয় ভাষায় শজঙ্গলি বলে অনেকেই চেনেন।
গাজী আউলিয়া, শিশু ‘দুঃখে’ (একটি শিশুর নাম) তার দুই চাচা ধনে আর মনে এর প্রতিমা এই দক্ষিণরায় তথা বাঘের মূর্তি তে রয়েছে। এছাড়া মন্ত্রপাঠ থেকে শুরু করে নৈবেদ্য অর্পণ ইত্যাদি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রসাদ বিতরণ এবং সিন্নি বিতরণ করা হয়ে থাকে।
বন বিবি পূজার ব্রতকথা:
অনেক বছর আগে সুন্দরবনের পাশের গ্রামের এক দরিদ্র মায়ের শিশু ছেলে ‘দুঃখে’কে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করতে নিয়ে যান ধনে আর মনে নামে দুই ব্যবসায়ী। দুঃখেকে তার মা বলেন, “বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছেন, কোন বিপদে পড়লে তাকে ডাকবি”।
তখন বনে গাজী নামে এক আউলিয়া থাকতেন, দক্ষিণরায় বাঘ রুপি অপশক্তি গাজীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল। একদিন রাতে রায়মনি বা দক্ষিণরায় ধনে ও মনে কে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনি দুই ভাইকে প্রচুর মধু আর সম্পদ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দুঃখেকে উৎসর্গ করতে বলেন আর যদি না হয় এমনটা, তবে তাঁদের নৌকা ডুবে যাওয়ার এবং মধু না পাওয়ার ভয় দেখান। ধনে আর মনে ভয়ে ‘দুঃখে’ কে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে জল আনতে পাঠিয়ে নৌকা ছেড়ে চলে যান।
দুঃখে মায়ের কথা মতো সেই মাকে স্মরণ করতে থাকে ভয়ের কারণে। বনবিবি এসে দুঃখে কে বাঘ রুপি দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে উদ্ধার করেন এবং তাকে কুমিরের পিঠে ভাসিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। এদিকে বন বিবির ভাই শাহ জঙ্গলি বাঘ্ররুপী দক্ষিণ রায় ও গাজী আউলিয়া কে ধরে বন বিবির কাছে নিয়ে যান। গাজী দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির পক্ষ নেন। এভাবেই পরবর্তী সময়ে বনবিবি সুন্দরবনজীবী মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পেয়ে পুজিতা হতে শুরু করেন।
বনবিবি পূজার নিয়ম:
বনবিবি হলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবী, মধু সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী তথা পিরানি। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে থাকেন স্থানীয় মানুষজন। এই দেবীকে বন বিবি, বনদেবী, বন দুর্গা, ব্যাঘ্র দেবী বা বনচন্ডী নামেও অনেকেই চিনে থাকবেন।
বনবিবি হিন্দু সমাজে বন দুর্গা, বনদেবী নামে পুজিতা হন। তিনি মাতৃ দেবতা, ভক্ত বৎসলা ও দয়ালু। তার মূর্তিও সুশ্রী ও লাবণ্যময়ী। হিন্দুদের পূজা মূর্তিতে তার গায়ের রং হলুদ, কণ্ঠহার ও বনফুলের মালা পরে রয়েছেন এবং লাঠি অথবা ত্রিশূল ধারিনী। মুসলমান সমাজে বনবিবি পিরানি হিসেবে পরিচিত। ইসলামিক ক্ষেত্রে মূর্তি গুলিতে তিনি টিকলির সঙ্গে টুপি পরিধান করেন, চুল বিনুনি করা, ঘাগরা পায়জামা, শাড়ি এবং জুতো পরে রয়েছেন। তবে উভয় মূর্তিতেই তার কোলে পুত্ররূপে দুঃখে কে দেখা যায়, আর বনবিবির বাহন হল বাঘ অথবা মুরগি।
বনবিবির পূজাতে তেমন কোন নির্দিষ্ট নিয়ম অথবা বিধি নেই, নামাজের কলেমা পড়ে ভক্তদের জন্য দোয়া অথবা প্রার্থনা করা হয়। ভক্তরা ধূপ জ্বালিয়ে এবং ফলমূল, বাতাসা, সন্দেশ ও দক্ষিণা দিয়ে পূজা সম্পন্ন করেন। গণ্ডি দেওয়া ও চন্দন মৃত্তিকা গ্রহণ পূজার একটি বিশেষ অংগ। এ ছাড়া স্থানীয়দের বিশ্বাস অনুসারে দেবী জাগ্রত এবং ভক্তের সকল প্রার্থনা তিনি পূর্ণ করেন। এছাড়া ভক্তেরা রোগ মুক্তির জন্য দেবীর মন্দির এ ঢিল বেঁধে মানত করেন।
পরে রোগ মুক্তি করলে সে মন্দিরে গণ্ডি দেওয়া হয়, বাতাসা লুট দেওয়া হয়, বুক চিরে রক্ত দেওয়া হয়, এই সমস্ত প্রাচীন রীতি ও প্রথা পালন করা হয় আজও পর্যন্ত। এর পাশাপাশি অধিক ফলনের জন্য মানত করলে ক্ষেতের প্রথম ফসলের ধানের আঁটি বা বিচলী, মূলা, বেগুণ ইত্যাদি দেবীর মন্দিরে অথবা থানে দেওয়া হয়। এছাড়া হাঁস, মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য মানত করে যদি সেই কাজ সম্পন্ন হয় তাহলে পূজার জায়গায় হাঁস মুরগির বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ার রীতিও প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া জমি বা কৃষিজ যন্ত্রপাতি কিনে তা থেকে ভালো পরিষেবা পাওয়ার জন্য অনেকেই মানত করে থাকেন এবং যদি মনের ইচ্ছা পূরণ হয় তাহলে ছলন ও বাজনা সহ বনবিবির পূজা দেওয়া হয়।
এর পাশাপাশি এই পূজার সাথে জড়িত রয়েছে আরও অনেক অনুষ্ঠান ও উৎসব, ঘুড়ি ওড়ানো এবং ঘুড়ি লোটার প্রথাও রয়েছে। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে এবং দর্শনার্থীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো এবং রাতে গান, নাটক, যাত্রা ইত্যাদির আয়োজন করা হয় অনেক জায়গায়। বনবিবির যাত্রা হলেও অনেকে অনেক দূর থেকে সেই যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেই মেলায় ভিড় জমান। কিছু কিছু জায়গায় বনবিবি পূজা উপলক্ষে খুবই বড় আকারে মেলা বসে এবং সেখানে মনোহারী দোকান থেকে শুরু করে লোহার কৃষিজ যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, থেকে শুরু করে রেডিমেড পোশাক-আশাক, মিষ্টি, ফুচকা, তেলে ভাজা খাবার ইত্যাদির দোকান বসে এবং সেখানে বেশ কিছুদিন ধরে স্থানীয় মানুষজন দের মন আনন্দে উৎসবে মেতে থাকে। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় সারা রাত ধরে জুয়া খেলার আসর চলে।
দুই বাংলার সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীরা বনবিবির মন্দির স্থাপন করেছেন ঠিকই তবে বিভিন্ন জায়গায় বড় আকারের বন বিবির মন্দির চোখে পড়ে। যেমন ধরুন সজনে খালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য দো-বাঁকি অভয়ারণ্য ও দয়াপুর গ্রামে বনবিবির মন্দির চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া বনবিবির পূজার সময় বিভিন্ন জায়গায় বড় আকারে মন্ডপ সাজিয়ে সেখানে বড় আকারে বনবিবির প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেও সেখানে পূজা-অর্চনা করা হয়ে থাকে।