Worldwide Bengali Panjika

দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজা পদ্ধতি – Tripura Sundari Puja


দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজা (Tripura Sundari Puja): দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপ এর পূজা করা হয় আর সতী পার্বতীর দেহের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছিল সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি শক্তিপীঠ (Shakti Pitha)। দেবী দুর্গার আরো একটি রূপ হল ত্রিপুরা সুন্দরী (Tripura Sundari)। ত্রিপুরা সুন্দরীর মধ্যে কালী শক্তি ও দুর্গার সৌন্দর্য ও মহত্বের সম্মিলিত রূপ লক্ষ্য করা যায়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

ধর্মীয় সাহিত্যের বর্ণনা অনুসারে তিনি ত্রিনয়নী, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বর পরিহিতা, স্বর্ণ অলংকারে ভূষিতা ও স্বর্ণ সিংহাসনের উপরে পদ্ম আসনে উপবিষ্টা। তার হাতে যে জিনিসগুলি রয়েছে সেগুলি শিবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তার মূর্তিতে রাজকীয় আভা থাকায় তাকে রাজরাজেশ্বরী (Rajarajeshwari) নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজা ও মন্দিরের কিছু কথা:

বিভিন্ন জায়গা বিশেষে দেবীর বিভিন্ন রূপের পূজা করা হয়, তেমনি ত্রিপুরাতে ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজা (Tripura Sundari Puja) খুবই আরম্ভপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা হয়। ত্রিপুরার প্রাচীন যে রাজ্যসীমা ছিল তাতে তিনটি শৈব পিঠের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কুমিল্লার ১৭ রত্ন মন্দির, রাজরাজেশ্বরী মন্দির, পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দির, বিভিন্ন পুরান তাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে অনুমান করা যায় যে এই অঞ্চলে একসময় পাল, চন্দ্র, দেব বংশ রাজারা রাজত্ব করতেন।

আর রাজ রাজাদের রাজত্বকালে বহু মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে এবং দেবীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা আজও অনেক জায়গায় বর্তমানে সেই মন্দির ও প্রতিমা লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে আমরা পাল বংশের রাজত্বের কথা জানতে পেরেছি। মন্দিরটি ৭৫ ফুট থেকে মন্দিরের চূড়ায় দেখা যায় খুব সুন্দর ভাবে। মন্দিরের তিনদিকে ভোগ রান্না করার জন্য আলাদা করে রান্নাঘর রয়েছে। পুরোহিত দের থাকার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা আছে, মন্দিরের স্থাপত্যে বৌদ্ধ প্রভাব সুস্পষ্ট বোঝা যায়।

ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজা পালন:

প্রতিটি মন্দিরের এবং প্রতিটি দেবদেবীর কোনো না কোনো নির্দিষ্ট পূজার নিয়ম থাকে আর সেই নিয়ম মেনে ভক্তরা সেই দেবদেবীর অথবা সেই মায়ের পূজা করে থাকেন, তবে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের ত্রিপুরা সুন্দরীর পূজার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। প্রতিদিন ভোর চারটে দেবী মায়ের মঙ্গল আরতি এবং ভোগ নিবেদন সম্পন্ন করা হয়। এরপরে সকাল আটটায় শুরু হয় দেবীর স্নানকার্য।

তার পরে পরে সকাল সাড়ে নটায় বলি প্রথা প্রচলিত রয়েছে এবং বলি দিয়ে মায়ের পূজা শুরু করা হয়। এরপর সন্ধ্যা সাতটায় মায়ের সন্ধ্যা আরতি শুরু হয় এবং রাতের বেলা সাড়ে নটায় আবার মায়ের ভোগ নিবেদন এবং মায়ের নিদ্রা যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই মন্দিরের বলির সময় মায়ের সঙ্গে নিয়ে ডাকিনী যোগিনীদের উদ্দেশ্যে সেই বলির বস্তুটি উৎসর্গ করা হয়। এই বলি দেওয়ার কিছু অংশ কল্যাণ সাগরের কচ্ছপ এবং মাছের খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়।

প্রাচীন মন্দির গুলিতে এমন অনেক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে যা আজও গায়ে শিহরণ জাগায়। মন্দিরের সামনে দিকে প্রায় সাড়ে ছয় একর জমি জুড়ে একটি পুকুর বা একটি দীঘি দেখতে পাওয়া যায়, স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় যে, তা ‘কল্যাণ সাগর (Kalyan Sagar)’ হিসেবে পরিচিত সকলের কাছে।

সাগরের জলে বিভিন্ন জলজ প্রাণিসহ মাছ এবং কচ্ছপ রয়েছে। বহু দূর দূরান্তর থেকে আগত পুণ্যার্থীরা পূণ্য অর্জন করার জন্য এখানে এসে ভিড় জামান। মায়ের পূজা সম্পন্ন করেন এবং এই সমস্ত জলজ প্রাণীদেরকে মুড়ি, বিস্কুটসহ আরো অন্যান্য খাবার খাইয়ে থাকেন তাদের ইচ্ছা অনুসারে। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের মুখে শোনা যায় নিশুতি রাতে বৃহৎ আকারের কচ্ছপ গুলো মন্দিরের চাতালে উঠে আসে এবং মায়ের মন্দির ঘিরে রাখে।

পূজা নিয়মের মধ্যে এই মন্দির প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখলে বোঝা যায় পূণ্যার্থীরা মোমবাতি, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবীকে আরাধনা করেন এবং নিজের মনের কষ্ট জানান। আর অনেক পুণ্যার্থীদের পূজা-অর্চনায় মগ্ন থাকতে দেখা যায়। আবার অনেকেই দণ্ডী কাটেন, নিজেকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে দেবীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। তাইতো জানা যায় যে, ভক্তিতে থাকে অনেকখানি শক্তি, তাই ভক্তি সহকারে নিষ্ঠা ভরে যদি দেবীর পূজা অর্চনা করা যায় তাহলে ভক্তদের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

মায়ের জন্য বলি:

দেবী মাকে সন্তুষ্ট করতে বলি দেওয়ার প্রথা প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত হলেও বর্তমানে তা অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছে। স্থানীয়দের এবং আগত পূণ্যার্থীদের সাথে সাথে সেখানকার আশেপাশের মানুষজন দের কাছ থেকে জানা যায় যে প্রতিবছর দীপাবলিতে ৪ থেকে ৫,০০০ পাঁঠা বলি দেওয়া হতো। এই মন্দিরে সে সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আসেন মন্দিরে পূজা দিতে। কেউ আবার কেবলমাত্র পরিদর্শন করতে আসেন তবে সেই বলি আজ কমে বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ টি পাঠা বলি দেওয়া হয়।

পূজা অর্চনার পাশাপাশি মন্দির কে ঘিরে দীপাবলীর (Diwali) দিন ছাড়াও বছরজুড়ে বিশাল বড় মেলা বসে। তবে দীপাবলীর সময় মেলার পরিধিটা কয়েক কিলোমিটার বেড়ে যায়। মেলায় বিভিন্ন দোকানে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন পণ্য ও মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় পাওয়া যায়, দেবীর নামে অঞ্জলি দেওয়ার নানা ফুল ও খাদ্য দ্রব্য।

এছাড়া এই মন্দিরের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সেই কারণে শুধুমাত্র পুজো দেওয়ার জন্যই নয়, অনেক পর্যটকরা ওখানে নিজেদের চোখের শান্তি এবং সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে চলে আসেন। মন্দিরের উপরিভাগ এবং চারিদিকে লাল রঙ দিয়ে রাঙানো হয়েছে যা এই মন্দিরটিকে একটা আলাদা রূপ দিয়েছে।

পূন্যার্থীরা ও ভক্তরা যা করেন:

মন্দিরে যাঁরা পূজা দিতে আসেন, ভোগ নিবেদন করতে আসেন, তাঁদের পছন্দমত ভোগ কিনে নিয়ে মন্দিরের মায়ের ভোগ দিতে চলে যান। তবে যাঁরা কেবলমাত্র মন্দির পরিদর্শন করতে আসেন, তাঁরা ভোগ না কিনেও মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন, সেই অনুমতি রয়েছে।

মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে অসংখ্য নারীদের হাতের শাখা, পলা, সিঁদুর, চন্দন কাঠ, ধর্মীয় পুস্তক সহ পূজা অর্চনা ও বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, আসবাবপত্র এবং পোশাকের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই মন্দির চত্বরে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিষ্টান্ন এর সন্দেশ অথবা প্যারা বলে থাকেন অনেকে সেটি খুবই জনপ্রিয়। আর এটি কিনে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভক্তদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!