Worldwide Bengali Panjika

নল সংক্রান্তি পূজা ও নিয়ম – Nal Sankranti


নল সংক্রান্তি (Nal Sankranti): এমন অনেক উৎসব রয়েছে যা আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে, তবে এখনো পর্যন্ত গ্রামবাংলায় সেই সমস্ত উৎসব গুলিকে টিকিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার মানুষজন। তেমনই এক প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক লোকাচার হলো ‘নল সংক্রান্তি’ এর যেমন পূজা বিধি রয়েছে তেমনি রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব এবং অনেক অজানা তথ্য।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

প্রাচীন লোকাচার হলো এই নল সংক্রান্তি (Nal Sankranti)। বাংলার প্রাচীন প্রথাটি মূলত রাঢ় বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়। কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ হিসেবে এই প্রথা সেই সব থেকেই দেখে এসেছেন অনেকেই।

গ্রামীণ লোকাচার নল সংক্রান্তি আর ডাক সংক্রান্তি দুটোই কিন্তু একই প্রথা, শুধু অঞ্চল ভেদে নাম হয়তো একটু আলাদা আলাদা, তবে বেশিরভাগ এলাকায় এই প্রথাটি নল সংক্রান্তি নামেই পরিচিত।

নল সংক্রান্তি পূজা উৎসব:

আশ্বিন মাসের শেষ দিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনে এই প্রথাটি পালিত হয় গ্রামবাংলায়। বিশেষ করে এই সময় হল ধান গাছে ফসল আসার সময়। ধান গাছে ফুল হয় অর্থাৎ অনেকেই বলে থাকেন ধান গাছ এই সময় গর্ভবতী হয়। আর ধানের ভিতরের অংশটি এই সময়ে একেবারে দুধের মত থাকে।

যদিও পরবর্তী পর্যায়ে সূর্যের তাপে এবং পরিপুষ্ট হয়ে তা চালে পরিণত হয়। এই নরম মিষ্টি দুধ অংশটি পোকা-মাকড়ের খুবই প্রিয়, ফলে ধানের উপরে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব ভীষণভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে সেই পোকামাকড় গুলি ধানের ক্ষতি করে এই ধানের দুধ শুষে নেয়। ধানের পুষ্টি হয় না, ধান থেকে চাল পাওয়া যায় না, সবকিছুই আগাছা হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে যায়।

কৃষক পরিবার গুলির দুঃখের সীমা থাকে না এই সময়, তখন ফসল বাঁচাতে কৃষকরা এক পদ্ধতি অবলম্বন করতেন পরে সেটি এই প্রথা হিসেবে প্রচলিত হয়েছে আসছে। অর্থাৎ কৃষকরা বলতেন যে ধান গাছের সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান হল নল সংক্রান্তির উৎসব।

নল সংক্রান্তি উৎসব উদযাপনের নিয়ম:

এইসবের সাথে অনেকেই ভীষণ ভাবে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শেষের আগের দিনে নল গাছ কেটে আনা হয়। নিম, কালমেঘ, তুলসী, ওল, ভেট, আদা, বয়রা, চাল কুমড়ো খাড়া, মান কচু, কেতকি, নোটে খাড়া, শশা গাছ, বেলপাতা কে ইত্যাদি দশ রকমের ভেষজ খুব ছোট ছোট করে কুচি করা হয়। তারপর আতপ চাল ও শুকনো চিংড়ি মাছ মিশিয়ে নেওয়া হতো। এরপর ওই মিশ্রণটি বড় পাতা দিয়ে মুড়ে নল গাছে পাট দিয়ে বাঁধা হয়। মুখে কোন কথা বলা যাবে না এই সময়। সারা গ্রামের চাষিরা জড়ো হন, এই সময়ে রাত জেগে নল বাধার কাজ চলে।

সংক্রান্তির দিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই এই মিশ্রণ বাধা নল টি জমিতে ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হয়। তবে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য এবং মজাদার বিষয় হলো এই সময় একটা ছড়া অথবা কবিতা সুর করে গাইতে থাকেন কৃষকেরা। সেই ছড়াটি অনেকটা এরকম:-

“নল পড়লো ভুঁয়ে, যা শনি তুই উত্তর মূয়ে,” এখানে শনি অর্থাৎ যে সমস্ত পোকা মাকড় ধান ক্ষতি করে সে সমস্ত পোকা মাকড় কে বোঝানো হয়েছে। কৃষকেরা এটাকে গর্ভবতী ধান গাছকে সাধ খাওয়ানোর কথা বলেন। নল সংক্রান্তিতে নলপোতা নিয়ে লোকমুখে প্রচারিত যে ছড়া রয়েছে সেটি নিম্নরূপ:-

“অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি, যারে পোকা ধানকে ছাড়ি, এতে আছে শুক্তা, ধান ফলবে মুক্তা, এতে আছে কেঁউ ধান হবে সাত বেঁউ, এতে আছে হলদি, ধান ফলবে জলদি, এতে আছে ওল, মহাদেবের ধ্যান করে বল রে হরিবোল।”

নল সংক্রান্তির এই প্রথার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য:

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় যে ফসল বাঁচানোর এই প্রথাটি প্রচলন শুরু হয়েছিল আজকে থেকে অনেকদিন আগে অর্থাৎ আজও পর্যন্ত অনেক রকম কীটনাশক ব্যবহার করে এই ধানের সর্বনাশ রোধ করা যায় ঠিকই তবে আগের এই প্রথা ধানের কোনরকম ক্ষতি না করে পোকামাকড় তাড়ানো যায়।

যখন থেকে এই প্রথার প্রচলন হয়েছে তখন এত রাসায়নিক এবং কীটনাশকের আবির্ভাব ঘটেনি। কীট পতঙ্গের হাত থেকে ফসল কে রক্ষা করার জন্য এই মিশ্রণটি তৈরি করা হয়। এটি তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত বলেই পোকামাকড় সহজেই আর ফসলের এলাকায় আসতে পারতো না। রক্ষা পেতো কৃষকদের কষ্টের ফসল।

শুধু তাই নয় জমির মাঝে এই যে নল গাছ পুঁতে রাখা হয় সেটিতে পেঁচা প্রভৃতি পাখিরা এসে বসে এবং সেখান থেকে তারা খুব সহজেই ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় গুলি ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। পুরো বিষয়টি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে খুবই উপকৃত বলে মনে করা হয় এবং কৃষকদের চিন্তা দূর করে এই প্রচলিত প্রথা, যা আজ উৎসবে পরিণত হয়েছে।

নল সংক্রান্তি যেভাবে পালন করেন কৃষকরা:

  • এই শুভদিনে খুব ভরে একটি ঝুড়িতে রাখা হয় ওল, নিমপাতা, হলদি, এক পুটুলি আতপ চাল।
  • স্নান সেরে ওই ঝুড়ি জলে চুবিয়ে একটা পিতলের ঘটিতে জল নিয়ে আসতে হয় বাড়ির কোন সদস্যকে। সেটা যদি কোন মহিলা সদস্য হয় সেটা খুবই ভালো।
  • সেই জল দিয়ে নিমপাতা আর হলুদ বেটে খেলেই নাকি শরীরের সকল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • প্রতি বাড়িতে এই সময় নিমপাতা, হলুদ আর আতব চালের বাটা বা আলই খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এর সাথে খাওয়া হয় তাল আঁটির গজাড়।
  • এছাড়া এই উৎসব উপলক্ষে পিঠে পুলি তৈরি করা হয় এবং দুপুরে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের তৈরি তরকারি, সাত রকমের শাক ভাজা, বিউলির ডাল, মাছের টক, ওলের তরকারি ইত্যাদি ব্যঞ্জন খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে।
  • সবমিলিয়ে মাঠভর্তি ধান রক্ষা করার পাশাপাশি প্রতিটি বাড়িতে চলে উৎসবের আয়োজন।

শুধুমাত্র বাড়ির সদস্যদেরই নয় বাড়ির গরুকেও কাঁচা হলুদ এবং নিম পাতা খাওয়ানোর রীতি প্রচলিত রয়েছে যদিও বর্তমানে এলাকার বেশিরভাগ মানুষের ধানের জমি পরিণত হয়েছে মাছ চাষ করার ক্ষেত্রে অথবা অনেকেই বিভিন্ন রকমের কলকারখানা তৈরি করে করার জন্য জমি জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন।

তবুও এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে কৃষকদের শেষ ভরসা তাঁদের চাষের জমিটুকুই। গ্রাম বাংলায় এমন অনেক প্রথা রয়েছে যেগুলি ছোট ছোট হলেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং উৎসবের আমেজে সকলে মেতে ওঠেন। এমনও অনেক প্রথা রয়েছে যা আমরা কখনোই শুনিনি অথবা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সেই প্রথা আজও টিকিয়ে রেখেছেন সেখানকার কৃষক পরিবারগুলি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!