Worldwide Bengali Panjika

ইতু পূজা ও ব্রত পালন বিধি – Itu Puja Vrat


ইতু পূজা (Itu Puja) – ইঁয়তি পূজা (Yati Puja): হিন্দু মহিলারা বিভিন্ন ধরনের ব্রত পালন করে থাকেন, তবে এমন একটি ব্রত যা শ্রী শ্রী মিত্র প্রতিষ্ঠা পূজা (Mitra Pratishtha Puja) হিসেবে পরিচিত তবে চলতি ভাষায় যাকে ইতু পূজা বলা হয়।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

এই পূজা অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র হয়, উপবাস রেখে পূজা করা হয় বলে একে সূর্যের পূজাও বলা হয়ে থাকে। সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পূজার রীতি উপাচার বিশ্লেষণ করে এই ব্রত কে মাতৃ দেবী রূপে গণ্য করে থাকেন অনেকেই।

এছাড়া ইতু দেবীর ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে আঁকা হয় এবং ভেতরে দেওয়া হয় শস্য দানা ও ঘাসের গুচ্ছ। ঘটের বেড়ির উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়, এরপর ওই সরাতে দেওয়া হয় মাটি আর মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করতে হয়। আর বাকি অংশ তে থাকে কলমি শাক, সরষে গাছ, শুষনির মূলসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য থাকে। এছাড়া ধানের বীজ মান কচুর মূল লাগানো হয়ে থাকে, আর ছোলা, মটর, মুগ ডাল, তিল, যব সহ ৮ রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়ে থাকে।

ইতু পূজা বাংলার একটি লোকউৎসব, অগ্রহায়ন মাসের প্রতি রবিবার শস্য বৃদ্ধির কামনায় এবং পরলোকে মোক্ষ লাভের ইচ্ছায় ইতু অথবা ইঁয়তি পূজা করা হয়ে থাকে। কার্তিক সংক্রান্তিতে ইতু পূজার প্রতিষ্ঠা অথবা শুরু করা হয়, অর্থাৎ ঘট স্থাপন করে শস্য দানা ছড়ানো হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসের শেষে এই পূজার সমাপ্তি ঘটে, এক কথায় বলা যেতে পারে সমগ্র একমাস জুড়ে বা সম্পূর্ণ অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে এই পূজা চলতে থাকে, আর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে গিয়ে এই পূজা শেষ হয়।

অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার পুজো করে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে ইতু বিসর্জন করার প্রথা রয়েছে। প্রতি রবিবারে ব্রত রাখলে, উপবাস অথবা অপারগে ফলমূল, শাকসবজি ভোজন করা অবশ্যই কর্তব্য।

শ্রী শ্রী মিত্র প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ইতু পূজা:

এই পূজা, গ্রাম্য ভাষায় ঘটবারি পূজা নামেও অনেকেই চিনে থাকবেন। ছোট ছোট কুমারী মেয়েরা এই পূজাতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। বাড়ির ঠাকুর ঘরের এক কোনায় এই পূজার ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ইতু পূজা হল গ্রাম বাংলার লক্ষীর সঙ্গে মিশে থাকা এক উৎসব এবং সেটি শস্য, সৌভাগ্য, আর মঙ্গলের প্রতীক। কুমারী মেয়েদের স্বামী লাভ বা বিবাহিত মেয়েদের সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এর সাথে সাথে সংসারের কল্যাণ সাধনায় প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।

এই পূজা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই একসাথে গোল হয়ে বসে এই পূজার ব্রত কথা শুনে থাকেন। ইতু ব্রত কথায় বলা হয়েছে অষ্টচাল, অষ্ট দূর্বা, কলসপত্র ধরে, ইতুর কথা এক মনে শুনে, নিজের ভক্তি ও নিষ্ঠা অর্পণ করা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে মেয়েরা নিজেরাই এই পূজা করে থাকেন। ইতু কে সাধ ভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও, সেদিন নতুন গুড় ও চাল, দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করতে হয়।

ইতু পূজার ব্রত কথা ও পুজার শুভ ফল লাভ

ইতু পূজার উপকরণ:

প্রতিটি পূজায় যেমন বিশেষ কিছু উপকরণ প্রয়োজন হয় তেমনি এই পূজাতেও এমন কিছু উপকরণ প্রয়োজন পড়ে যেগুলি আপনাকে অবশ্যই জোগাড় করে রাখতে হবে:-

  • একটি সুন্দর মাটির সারাতে মাটি ভরে তার মধ্যে দুটি ঘট স্থাপন করতে হবে এবং
  • সুপারি,
  • মান কচু,
  • কলমি লতা,
  • হলুদ,
  • আঁখ,
  • শুষনি,
  • সোনা ও রুপার টোপর,
  • জামাই নাড়ু,
  • শিবের জটা,
  • কাজল লতা,
  • ফুলের মালা,
  • ধূপ,
  • প্রদীপ,
  • সিঁদুর প্রভৃতি পূজার উপকরণ ও
  • ফল, মিষ্টান্ন আর
  • নবান্ন রাখতে হবে।

ইতু পূজার মন্ত্র:

“ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ, তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ, তোমার শিরে ঢালী জল, অন্তিম কালে দিও ফল।”

“অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা কলস পাত্রে থুয়ে,
শুন এক মনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে,
ইতু দেন বর, ধনধান্যে পুত্র পৌত্রে বাড়ুক তাদের ঘর,
কাঠি-কুটি কুড়াতে গেলাম ইতুর কথা শুনে এলাম,
এ কথা শুনলে কি হয়?
নির্ধনের ধন হয়, অপূত্রের পুত্র হয়, অশরণের শরণ হয়, অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়, অন্তিম কালে স্বর্গে যায়।”

ইতু পূজার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য:

বাংলার ঘরে ঘরে মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকেন। এই পূজার রীতি ও অনুষ্ঠান বিশ্লেষণ করলে জানা যায় ইতু কে দেবী মায়ের রূপের কল্পনা করে মেয়েরা নিজেরাই এই পূজা করে থাকেন। প্রার্থনা জানানো হয় মনের ইচ্ছা ইতু মায়ের কাছে। শীতকালীন চাষের আগে রবিশস্যের বীজ সংগ্রহই ছিল ব্রত পালনের মূল উৎস।

বিবাহিত ও অবিবাহিত সব মেয়েরাই এই ব্রত পালন করতে পারবেন একবার ব্রত শুরু করলে পালন করতে হয় আজীবন। এমনটাই বিশ্বাস চলে আসছে। যতদিন না ব্রত পালনের ভার মেয়ে অথবা পুত্রবধূ নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ব্রতধারিকে পালন করতে হবে এই ইতু পুজো। প্রতি রবিবার পুজোর সময় বেশিরভাগ ব্রত পালনকারীরা নিরামিষ ভোজন করে থাকেন।

মাটির ছোট ঘট কে লাল-সাদা রঙে সাজানো হয়ে থাকে। সেখানে বীজ বপন করা হয়, চারা গাছ যখন অঙ্কুরিত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে সংসারের সুখ, সমৃদ্ধি ঘটছে। দুধ, ময়দা আর ফলের নানাবিধ প্রসাদে সাজানো হয়ে থাকে নৈবেদ্য আর এটা কে বলা হয় ইতুর স্বাদ ভক্ষণ। পূজোর পরে প্রসাদ বিতরণ করা হয়, সবার শেষে ব্রত কথা পাঠ করে পূজা সমাপ্ত করা হয়। আতপ চালের আঠা দিয়ে তৈরি ও বাতাসা দিয়ে তৈরি কাঁচা পিঠে এই পূজাতে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করা হয়।

এইভাবেই গ্রাম বাংলার মা ও ঠাকুমা, দিদারা এই ইতু পূজার এই প্রচলন আজও পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন।কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে ঘট স্থাপন করে আট রকম শস্যকলাই এর বীজ বপন করে তা এক মাস ধরে পূজা ও পরিচর্যার মধ্যে দিয়ে যত্ন করা হয়। তারপর অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে এই পূজা সম্পন্ন করে তা বিসর্জন দেওয়া হয়। প্রচলিত ধারণা অনুসারে ইতু বিসর্জন করার সময় যে এই ব্রত পালন করবেন সেই নারী ঘট বিসর্জন দেওয়ার সাথে সাথে নিজেও এই ঠান্ডার মধ্যে খুব ভোরে সূর্য ওঠার অনেক আগে নিজেও সম্পূর্ণ স্নান সেরে বাড়িতে আসবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!