হিন্দু ধর্মে শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যায় জন্মগ্রহণ করলেও ১৪ বছর বনবাসের কাটাতে হয়েছিল পিতার আদেশে। তবে ভারতের ইতিহাসে রামায়ণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক আবেগ বলা যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘রামনবমী‘ উৎসব সকলের মনে বিশেষভাবে সাড়া জাগায়। তবে অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা অথবা উদ্বোধন নিয়ে যে উৎসব সেই উৎসব সমগ্র ভারতবর্ষে সাড়া জাগিয়েছে।
প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)
ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়, বন-জঙ্গল, দ্বীপের বাসিন্দারা এক জায়গায় একসঙ্গে এই ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাক্ষী রয়েছেন, যেখানে শ্রী রামচন্দ্রের জন্মভূমিতে রাম মন্দিরে শ্রীরামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
অযোধ্যার রাম মন্দিরের শ্রীরামচন্দ্রের (রামলালা) প্রাণ প্রতিষ্ঠা:
জানা যায় প্রায় ৫০০ বছর অযোধ্যায় এই রাম মন্দির নিয়ে আন্দোলন চলে, বলতে গেলে ৫০০ বছরের পুরনো আন্দোলনের ইতি হয়। মন্দির নির্মাণ থেকে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ভক্তদের উৎসাহের সীমা নেই। এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে রামলালার মূর্তির পবিত্রতাকে চিহ্নিত করবে।
দেশ ব্যাপী বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, বিভিন্ন উপজাতি, উপদলের প্রতিনিধি এবং আরো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সাক্ষী রয়েছেন এই অনুষ্ঠানে, নেতৃত্বে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা:
যেকোনো পূজাতে প্রতিমা অথবা মূর্তিতে প্রথমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার পরে পূজা-অর্চনা করা হয়ে থাকে। প্রাণ প্রতিষ্ঠা এক কথায় যার অর্থ হল একটি মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করা।
এই কাজে সফলতা পেতে বেদ ও পুরাণ থেকে প্রাপ্ত জটিল আসল অনুষ্ঠান একটার পর একটা ধাপে ধাপে অনুসরণ করে খুবই সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। সেই প্রতিটি ধাপ মেনে তবেই কিন্তু এই রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে:
১) শোভাযাত্রা:
প্রথমত কোন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পর্যায় অথবা ধাপ হলো শোভাযাত্রা। তেমনি এক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম, এই যাত্রায় মন্দিরের আশেপাশে প্রদক্ষিণ করানো হয় মূর্তিকে।
এরপর মন্দির অতিক্রম করার সাথে সাথে সেই স্থানের ঐশ্বরিক শক্তি জেগে ওঠে বলে বিশ্বাস করা হয়, প্রদক্ষিণকারীর মনের ভক্তি মূর্তির প্রাণ সঞ্চারের সূচনা করে। এরপর মণ্ডপে অথবা মন্দিরে প্রতিমা প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান।
২) অধিবাস এবং স্নান:
মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে একাধিক অধিবাস এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই অধিবাসের পরেই দেব মূর্তিকে স্নান করানো হয়। এরপরে অভিষেকের পালা আসে, বিভিন্ন রকমের অভিষেকের মধ্যে দিয়ে মূর্তি তে প্রাণ সঞ্চয় করা হয়।
এই রীতিতে ১০৮ টি বিভিন্ন ধরনের উপকরণ যেমন ধরুন পঞ্চামৃত, বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ফুল ও পাতার নির্যাস যুক্ত জল, গরুর শিং দিয়ে ঢেলে দেওয়া জল এবং আখের রস অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এইভাবে মূর্তির অধিবাস ও স্নান সম্পন্ন করা হয়।
৩) মূর্তিতে চক্ষু দান:
অনেক সময় দেখা যায় কোন পূজার সময় যখন প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় তখন চোখ ঢাকা থাকে এবং মন্ডপে অথবা মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার পরে বিশেষ কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করার পর সেই চোখের আবরণ খোলা হয়। আর সেই কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত ধাপ হল দেবতার চক্ষুদান।
দেবতার চোখের চারপাশে অঞ্জন দিয়ে একটি সোনার সুই ব্যবহার করা হয়, এই সুই দেবতার প্রথম দৃষ্টির প্রখরতাকে নিয়ন্ত্রণে আনে বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে হিন্দু ধর্মে।
এবার জানা যাক, রাম মন্দিরের রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা উৎসবে কোন কোন ধাপে এবং কোন কোন দিনে, কি কি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে:
নতুন বছরে নতুন চমক হিসাবে জানুয়ারি মাসে অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধন এবং রাম লালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা উৎসব সারা বছর কে সুন্দর ভাবে মনে করাতে পারে। এই জানুয়ারি মাসের বিশেষ কয়েকটি দিনে এই উৎসব সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
- ১৬ জানুয়ারি এই দিনটিতে প্রায়শ্চিত্ত ও কর্মকুটি পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
- ১৭ জানুয়ারিতে প্রাঙ্গণে মূর্তির প্রবেশ ঘটেছে।
- ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যাবেলা তীর্থযাত্রা পূজা, জয়যাত্রা, জল অধিবাস এবং গান্ধাধিবাস সম্পন্ন হয়।
- ১৯ জানুয়ারি সকালবেলা আউশ অধিবাস, কেশর অধিবাস ও ঘৃত অধিবাস পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
- ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা বেলা ধান্যধিবাস সম্পন্ন হয়।
- ২০ জানুয়ারি সকালবেলা শর্করাধিবাস এবং ফলাধিবাস অনুষ্ঠিত হয়।
- ২১ জানুয়ারি সকালবেলা মধ্যাধিবাস সম্পন্ন হয়।
- ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা বেলা ছায়াধিবাস অনুষ্ঠিত হয়।
- অবশেষে ২২ জানুয়ারি রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়।
রাম লালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা উৎসবে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন:
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অনুষ্ঠানে স্বয়ং উপস্থিত থেকে এই উৎসবের একজন হয়ে উঠেছেন এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ধর্ম সম্প্রদায় উপাসনা পদ্ধতির ঐতিহ্য এছাড়াও ১৫০ জনেরও বেশি সাধু সন্ত, মহান্ত যেমন মহামন্ডলেশ্বর, মন্ডলেশ্বর, শ্রীমন্ত, মহন্ত, নাগাসহ ৫৯ জনেরও বেশি আদিবাসী, গিরিবাসী, তত্ত্বাসী, দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী সম্প্রদায়ের আচার্যের হাত ধরে এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়া রাম মন্দির উদ্বোধন এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠা উৎসব উপলক্ষে চলচ্চিত্র জগতের তারকাদের মেলা বসেছিল। সকলেই এখানে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে হাজির হয়েছিলেন এমনকি রামায়ণের মুখ্য চরিত্র রাম, লক্ষণ ও সীতা, টেলিভিশনে অনুষ্ঠিত রামায়নে রাম, লক্ষণ ও সীতা মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যাঁরা তাঁরাও উপস্থিত ছিলেন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে।
শ্রী রামচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অরুণ গোভিল, লক্ষণের ভূমিকা অভিনয় করেছেন সুনীল লাহরী এবং সীতা মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দীপিকা চিখলিয়া। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তাঁরা মানুষের মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছেন যে এখনো পর্যন্ত অনেকেই তাঁদেরকে স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র, লক্ষণ ও সীতা মা হিসেবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করেন।
ভক্তদের প্রচুর দান, ভক্তি, শ্রদ্ধার পাশাপাশি সমগ্র অযোধ্যা জুড়ে চলছে উৎসবের সমারোহ। এমনকি আরও একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল অযোধ্যায় রাম মন্দিরের এই উৎসবের মধ্যে সামিল হয়েছে ১০৮ ফুটের একটি ধূপকাঠি, যা টানা ৪৫ দিন ধরে জ্বলবে আর আশেপাশের পরিবেশকে সুভাসিত করতে থাকবে। তবে জানা যায় ৩০০০ কেজি গোবর এবং আরো অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ১০৮ ফুটের ধূপকাঠি টি। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের উপহার, দান ও ভক্তি রামলালার জন্য আসতেই থাকছে অনবরত।