Worldwide Bengali Panjika

ভদ্রাবতী পূজা – Bhadravati Puja


ভদ্রাবতী পূজা (Bhadravati Puja): বিভিন্ন পূজা পার্বণের মধ্যে “ভাদর মাসে ভাদু পূজা” এটি অনেকের কাছে খুবই আনন্দের একটি উৎসব। তবুও কিন্তু বাংলার অন্যতম লোকসংস্কৃতি ‘ভাদু গান’ আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে এবং এই পূজাও আর তেমন একটা চোখে পড়ে না, তবে এখনো পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ব্লকের গোপালনগর গ্রামে চিরাচরিতভাবে বাংলার লোকশিল্প ভাদুগানে মাততেন সেখানকার স্থানীয় লোকশিল্পীরা।

WhatsApp প্রতিদিনের পঞ্জিকা নিজের হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে দেখুন (একদম ফ্রী)

ভাদু পূজা অথবা ভদ্রাবতী পূজার ইতিহাস:

অনেক কাল আগের কথা, পঞ্চকোট রাজ পরিবারের রাজা নীলমণি সিংদেওয়ারের তৃতীয় কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী। বিয়ের দিন ডাকাতদের হাতে হবু স্বামীর অকাল মৃত্যুতে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে পড়েন ভদ্রাবতী। সেই শোকে স্বামীর চিতায় শেষ করে দেন নিজেকে। মেয়ের স্মৃতিকে মানুষের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে বাবা নীলমণি সিংদেওয়ার ভাদু গানের প্রচলন করেন। ভাদু গান প্রেম ও রাজনীতি বর্জিত, বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পৌরাণিক ও সামাজিক বিষয়ে নানা পাঁচালীর সুরে গানের মধ্যে সমাজ সচেতনার বার্তা হিসেবে তুলে ধরা হয় এই ভাদু উৎসব এবং ভাদু গান।

ভাদু গান এবং এই উৎসবের প্রচলন সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে ভদ্রাবতী রাজকন্যা এবং রাজা এই দরবারী গান শুরু করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তা কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো ? তবে ভদ্রাবতী সম্পর্কে যে কাহিনী আমরা জানলাম এছাড়াও আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, যা ভাদু গান ও উৎসব সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন এত জনপ্রিয় সেটা বোঝায়।

ভদ্রাবতী পূজার আরও একটি কাহিনী:

পুরুলিয়া জেলার কাশিপুর অঞ্চলের একটি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক ভাদ্র মাসে তাঁর জমির মধ্যে সদ্যোজাত শিশুকন্যা কে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। কৃষক শিশুকন্যাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং সন্তান স্নেহে লালন পালন করতে শুরু করেন। সে বছর ভালো বৃষ্টি না হওয়ার জন্য কোনরকম চাষ আবাদ হচ্ছিল না, কিন্তু শিশু কন্যাটি বাড়িতে আনার দুইদিন পর বৃষ্টি শুরু হয় এবং খুব ভালো চাষাবাদ হয়। কৃষক পরিবার বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, এই শিশুকন্যাটি লক্ষীর স্বরূপ। রামায়ণের সীতাকে যেমন চাষের জমি থেকে পাওয়া গিয়েছিল সেই রকম এই কন্যাটিকেও সেই কৃষক পেয়েছিলেন।

ভাদ্র মাসে কন্যা টিকে পাওয়ার জন্য নাম দেওয়া হয় ভদ্রাবতী, অনেকের মতে ভদ্রেশ্বরী। সকলে আদর করে ভদ্রবাতীকে ‘ভাদু’ নামে ডাকতে শুরু করে। ভাদু বড় হবার সাথে সাথেই রুপে গুণে সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মীর মত দেখতে হয়, লোকোমুখে ভাদুর এই কথা শুনে পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংদেওয়ার গ্রামে এসে হাজির হন। ভাদুকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং বলেন “এই মেয়ে গ্রামের কোন সাধারণ কৃষকের মেয়ে হতে পারে না”। তিনি ভাদুকে রাজকন্যা বলেন এবং রাজপ্রাসাদের নিয়ে যেতে চান। কিন্তু ভাদু তার মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে রাজি না হলে রাজা ঘোষণা করেন ভদ্রাবতী যেখানেই থাকুক সে রাজকন্যা।

সখিদের সাথে খেলা করে ঘুরে আনন্দে জীবন কাটছিল, ভাদুর জীবনের অনেকগুলি শরৎকাল অতিক্রম করে ভাদু যখন যৌবনে পদার্পণ করে তখন পাশের গ্রামের এক সুদর্শন যুবক অঞ্জনের সাথে ভাদুর পরিচয় হয়। আর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়া হতে থাকে যা একসময় ভালবাসায় পরিণত হয়, ভদ্রাবতী গান গাইতো আর অঞ্জন সেই গানের সুরে বাঁশি বাজাত। এই সম্পর্কের কথা রাজা জানতে পারলে খুবই রেগে ওঠেন, তিনি চেয়েছিলেন তার কন্যাকে উচ্চ রাজবংশে বিবাহ দেবেন। অঞ্জন এর মত সমাজের সাধারণ ছেলের হাতে তার কন্যাকে কখনোই তুলে দেবেন না। রাজার আদেশে অঞ্জন কে আটক করে কোন গুপ্ত স্থানে রাখা হয়।

প্রাণের থেকেও প্রিয় অঞ্জনকে দেখতে না পেয়ে ভাদু ঘুরে ঘুরে বেড়াতো আর গান গাইতো। যদি তার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে অঞ্জন ফিরে আসে। দীর্ঘদিন ধরে দিন রাত এক করে ভাদু গান করতে করতে দুঃখ-কষ্টে অঞ্জন কে খুঁজতে থাকে। রাজা নীলমনি কন্যার এই রূপ দুরাবস্থা দেখে প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই অঞ্জনকে মুক্তি দিয়ে দেন। মুক্ত অঞ্জন তার ভাদুর কাছে গেলে ভাদুকে আর দেখতে পায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলেও ভাদুর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রামের অনেকে বলেন ভাদু আকাশ থেকে এসেছিল আকাশে ফিরে গেছে।

আবার অনেকের মতে ভাদু জমির মধ্যেই ফিরে গেছে। আবার অনেকের মতে ভাদু কান্না, নদী হয়ে ভাদুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় রাজা নীলমণি অত্যন্ত কষ্ট পান এবং ভদ্রাবতীকে স্মরণীয় রাখতেই ভাদু গানের সূচনা করেন। যদিও এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, কিন্তু ভাদু গানের ইতিহাস জানতে গিয়ে এই কাহিনীকেই সত্যি বলে মন থেকে মেনে নিয়েছেন যাঁরা ভাদু উপাসনা করে থাকেন।

ভদ্রাবতী পূজা অথবা ভাদু পূজার নিয়ম:

সাধারণত ভাদ্র মাসেই এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ২-১ দিন আগ পিছ হতে পারে। এই সময় কুমারী মেয়েরা বাড়ির কোন কুলুঙ্গি বা ছোট জায়গা পরিষ্কার করে ভদ্রাবতী প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা শুরু করে। একটি পাত্রে ফুল বা গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে সমবেত কণ্ঠে ভাদু গান গাওয়া হয়।

ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি বাড়িতে আনা হয়, পূর্বে ভাদু মূর্তি ছিল না, বর্তমানে হাঁস, ময়ূর বা পদ্মের উপরে ভাদুমূর্তি গড়ে ওঠে অভিজাত পরিবারের কুলোদেবী লক্ষীর মতো রূপে, যা দেখে মনে হয় মা লক্ষ্মী কুলীন ধনী পরিবারগুলোর সিংহাসনে বন্দি না থেকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছেন। ভাদু নামে অথবা ভদ্রাবতী নামে ভাদুকে ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী হিসেবেও অনেকেই পূজা করে থাকেন।

ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে ভাদু জাগরন পালন করা হয়। রঙিন কাগজ বা কাপড়ের তৈরি ঘরে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং বিভিন্ন মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগ অথবা নৈবেদ্য হিসাবে। বিশেষত খুবই বড় আকারে জিলিপি এবং গজা থাকে। জিলিপির আকার ছোট হলে মা ভাদু অভিমান করেন বলে অনেকেই মনে করেন। ভাদু উপাসকরা রাত ন’টা থেকে দশটা বাজলেই ভাদু গান গাইতে শুরু করে দেন। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে ভাদু মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় এবং অপেক্ষা করা হয় পরের বছরের জন্য।

ভাদূ পূজার একটি রীতি:

বীরভূমে ভাদু পূজার এই প্রথা একটু অন্যরকম। মূলত গ্রামের কয়েকজন মিলে একটি ভাদু মূর্তি এবং একটি ছোট ছেলেকে ভাদু সাজিয়ে গান করে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, সকলে এই দলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং কিছু পয়সা দান করে থাকেন।

ভাদু উৎসব হল একটি লোকউৎসব, এই উৎসব কোনো আচার অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় জটিলতায় আবদ্ধ নয়। এটি মূলত আনন্দ উদযাপন করার একটি উৎসব। পুরোহিত, উপবাস, মন্ত্র এই উৎসবে তেমন দেখা যায় না। পূর্বে প্রচলিত ছিল গান এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নতুন করে লেখা গান সমবেত কন্ঠে গাওয়া হত। এই উৎসব পালন করতে খুবই আনন্দ ও অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় ঠিকই তবে খুব একটা আড়ম্ভর থাকে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!