শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ ব্রত পালন পদ্ধতি (Satyanarayan Vrat): সংসারের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য সর্বদাই দেব দেবীদের সন্তুষ্ট করতে পূজা অর্চনা করা হয় এবং সাধ্যমত নৈবেদ্য ও ভোগ নিবেদন করে সেই প্রসাদ বিতরণ করা হয় সকলের মাঝে। এমনই একটি পূজা যা সকলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিচিত তা হল সত্যনারায়ণ ব্রত। হিন্দু ধর্মে সত্যনারায়ণ পূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এতে ভগবান সত্যনারায়ণ কে পূজা করা হয়, যা ভগবান বিষ্ণুর অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ। সত্যনারায়ণ মানে পৃথিবীতে একমাত্র ভগবান নারায়নই সত্য আর বাকি সবই মোহ মায়া।
তাছাড়া প্রতিমাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনেক গৃহস্থ বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজো ও অনুষ্ঠান রাখা হয় এবং সত্যনারায়ণের সিন্নি প্রসাদ পাওয়ার জন্য অনেক ভক্তগন সেই বাড়িতে পূজায় অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং নিমন্ত্রিত থাকেন। জানা যায় যে বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজার আচার অনুষ্ঠান পালন করা এবং ব্রতকথা শ্রবণ করা বা ব্রতকথা পাঠ করলে সুখ, সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় সংসারে। তবে আপনি যে কোন শুভ সময়ে সত্যনারায়ণের পূজা করতে পারেন, ব্রত পালন করতে পারেন। তবে পূর্ণিমার দিনে এবং সকালে এই পূজা করা খুবই শুভ বলে জানা যায়।
শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণের ব্রত পালনে প্রয়োজনীয় উপকরণ:
প্রতিটি পূজায় নির্দিষ্ট কিছু উপকরণ প্রয়োজন পড়ে সেগুলি ছাড়া সেই পূজা যেমন সম্পন্ন হয় না তেমনি সংসারে অমঙ্গল বয়ে আসতে পারে। তাই সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করতে আপনাকে যে সমস্ত উপকরণ গুলি জোগাড় করতে হবে সেগুলি নিচে দেওয়া হল:-
- নারকেল,
- লবঙ্গ,
- সুপারি,
- পান,
- এলাচ,
- পুজোর লাল সুতো,
- পৈতে,
- পঞ্চামৃতের জন্য কাঁচা দুধ, মধু, চিনি, দই ও ঘি,
- মিষ্টি,
- মৌসুমী ফল,
- সুগন্ধি আতর,
- হলুদ অথবা সাদা ফুলের মালা,
- দুর্বাঘাস,
- ধূপ,
- প্রদীপ,
- যজ্ঞের সামগ্রী,
- কালো তিল,
- যব,
- হলুদ কাপড়,
- কর্পূর,
- আমের পাতা,
- সিন্নি তৈরি করার বিভিন্ন উপকরণ,
- ঘট,
- শীষযুক্ত ডাব,
- কলা,
- গামছা,
- সিঁদুর,
- গঙ্গা মাটি,
- ধান,
- পাতন বস্ত্র,
- তীর কাঠি,
- সন্দেশ,
- বাতাসা,
- পয়সা,
- পতাকা,
- ছুরি,
- হরিতকি,
- বেলপাতা,
- পুজোর বস্ত্র,
- মধুর বাটি,
- গোময় ও
- দক্ষিণা।
শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করার নিয়ম:
- সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করার জন্য অবশ্যই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে।
- ভগবান সত্যনারায়ণ কে উত্তর অথবা পূর্ব দিকে মুখ করে বসে পূজা করতে হবে।
- এরপর উপাসনার জায়গাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করুন আর সাথে গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র করে নিন।
- তারপর একটি চৌকি সেখানে রেখে দিন।
- সেই চৌকির উপরে একটি হলুদ রঙের কাপড় বিছিয়ে রাখুন।
- সেই হলুদ কাপড়ের উপরে ভগবান সত্যনারায়ণের মূর্তি অথবা ছবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
- এরপর চৌকির চারপাশে ফুল দিয়ে আপনার মনের মত করে সাজিয়ে তুলুন।
- তারপর ঈশ্বরকে চন্দন ও হলুদের তিলক লাগান এবং ফুলের মালা অর্পণ করুন।
- চৌকির সামনে জলে ভরা একটি কলসি রাখুন আর একটি ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন।
- পুজোর জন্য পঞ্চামৃত তৈরি করুন এটিকে পূজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- তারপর ধীরে ধীরে দুর্বা ঘাস, তুলসীপাতা, পৈতে, নৈবেদ্য, ফল, মিষ্টি, সুগন্ধী আতর ইত্যাদি ভগবান কে নিবেদন করুন একে একে।
- সত্যনারায়ণ ব্রতকথা পাঠ করতে পারেন এবং শুনতেও পারেন, তারপর যজ্ঞ করুন।
- পুজোর পর ভগবানের আরতী করুন এবং পঞ্চামৃত প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করুন।
- আর এই দিনে অথবা এই উপবাস রাখার আগের দিন বা পরের দিন পর্যন্ত শুধুমাত্র সাত্ত্বিক খাবার খান।
সত্যনারায়ণ ব্রত পালনের উপকারিতা:
প্রতিটি পূজা অর্চনা মানুষের মনে এক রকম শান্তি প্রদান করে। মনের কষ্ট ঈশ্বরের কাছে জানিয়ে প্রার্থনা করা হয় সকল কষ্ট হতে দূরীভূত করে জীবনে সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। পূর্ণিমা তিথিতে সত্যনারায়ণ পূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং সুখ ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ প্রদান করে বলে জানা যায়।
যে ভক্তরা পূর্ণিমা তিথিতে সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করে পূজা করে থাকেন তাঁদের জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং মনের সকল বাসনা পূর্ণ হয়। এছাড়া উপবাস রেখে ব্রত পালন করার সাথে সাথে এই শুভদিনে বিষ্ণু সহস্রনাম জপ করতে পারেন। উপাসনা ও ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র গুলি জপ করতে পারেন। এটি জীবনের সমস্ত ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে আপনাকে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এই ব্রত পালন করার ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট তিথি নক্ষত্র এর বাধা নেই। যে কেউ প্রদোষকালে এই ব্রত পালন করতে পারেন। নারী-পুরুষ, কুমার কুমারী সকলেই এই ব্রত পালন করতে পারেন, পূর্ণিমা অথবা সংক্রান্তির দিন এই ব্রত পালন করা হয়।
সত্যনারায়ণ পূজোর নৈবেদ্য সাজানোর নিয়ম:
পূজায় বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় না হলে এই নিয়মের অন্যথা হলে সংসারে শুভ হওয়ার পরিবর্তে অশুভ হতে পারে। সেই কারণে খুবই সাবধানতার সাথে পূজার নৈবেদ্য এবং ভোগ সাজাতে হয়, যা দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে সাহায্য করে।
এই পূজার জন্য যে পূজার থালা অথবা পাত্রে নৈবেদ্য রাখা হবে তা প্রথমে তেঁতুল দিয়ে পরিষ্কার করে রাখার নিয়ম রয়েছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় নৈবেদ্য রাখা প্রয়োজন। সকালে উপবাস করে তবেই এই পূজার নৈবেদ্য সাজাবার অনুমতি পাওয়া যায়। পূজার সরঞ্জাম ঠিক করার সময় নীল কাপড় পরিধান করা যাবে না, এতে কিন্তু গৃহে অমঙ্গল হতে পারে। সত্য নারায়ণের পাশাপাশি দেবী লক্ষ্মী ঠাকুরের জন্যও নৈবেদ্য সাজাতে হবে।
সত্যনারায়ণ পূজায় সিন্নি প্রসাদ তৈরির উপকরণ:
সত্যনারায়ণ পূজায় সিন্নি প্রসাদের মাহাত্ম্য রয়েছে বহুগুণ। সত্যনারায়ণ পূজোয় একটুখানি সিন্নি প্রসাদ দিতেই হয়, এর ফলে সত্যনারায়ণের আশীর্বাদ লাভ করা যায় বলে প্রচলিত বিশ্বাস চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। সত্যনারায়ণের মূল প্রসাদ হল এই সিন্নি, তাই খুব যত্ন নিয়ে সিন্নি বানানো হয়। এই সিন্নি ছাড়া সত্যনারায়ণের ব্রত অথবা পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাহলে জানা যাক এই সিন্নি প্রসাদ তৈরি করতে কি করতে হবে আপনাকে!
শুদ্ধ হয়ে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে হাত ভালো করে ধুয়ে তবেই সিন্নি প্রসাদ তৈরি করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সিন্নির পরিমাপ অনুযায়ী আপনি উপকরণের পরিমাপ বাড়াতে অথবা কমাতে পারেন। সিন্নি প্রসাদ তৈরি করতে লাগবে গমের আটা, আখের গুড় অথবা চিনি, সুজি, পরিমান মত কলা, বাতাসা, কিছুটা নারকেল কোরা ও কাঁচা দুধ, এগুলি দিয়ে সিন্নি বানাতে হয়। এছাড়া এর মধ্যে এক চামচ ঘি ও ফলের টুকরো মিশিয়ে দেওয়া হয়, সঙ্গে মেশাতে পারেন কাজু বাদাম, কিসমিস ও আমসত্ত্ব। আমরা আগেই জেনেছি পূর্ণিমা অথবা সংক্রান্তিতে গ্রামবাংলায় সত্যনারায়ণের পূজায় সিন্নি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে কোন মনস্কামনা পূরণের জন্য সত্যনারায়ণের পুজো দিলে তাতে অবশ্যই সিন্নি প্রসাদ দিতে ভুলবেন না কিন্তু।