Worldwide Bengali Panjika

সেঁজুতি ব্রত পালন নিয়ম ও মন্ত্র – Senjuti Vrat


ADVERTISEMENT

সেঁজুতি ব্রত (Senjuti Vrat): হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ব্রত পালন করা হয়, যেগুলি তার মধ্যে বেশিরভাগ ব্রত কিন্তু মেয়েলি ব্রত অর্থাৎ শুধুমাত্র বাড়ির মা ও বোনেরা অর্থাৎ মেয়েরা এই ব্রত পালন করে থাকেন। তবে অবশ্যই ছেলেরা এই ব্রত পালন করতে বিভিন্ন উপকরণ আনতে এবং পূজা ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকেন, তবে ব্রত পালন করতে এবং উপবাস রাখতে মেয়েরাই কিন্তু অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।

কার্তিক মাসের সংক্রান্তি অর্থাৎ শেষ দিন থেকে আরম্ভ করে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত প্রত্যেকদিন বিকেলে সেঁজুতি ব্রত বা পূজা-অর্চনা করতে হয়। বিশেষ করে কুমারী মেয়েরাই এই সেঁজুতি ব্রত পালন করে থাকেন।

গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দু ঘরের পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা কার্তিক মাসের সংক্রান্তি থেকে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বাড়ির উঠানে আলপনা দিয়ে এবং প্রদীপ জ্বালিয়ে এই সেঁজুতি ব্রত পালন করে থাকেন। এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্য হলো ভালো স্বামী পাওয়া এবং সুন্দর পরিবার লাভ করা। সন্তান লাভ, সর্বপ্রকার ধন-সম্পত্তির রক্ষা ও সুখ বৃদ্ধি এবং সুখ শান্তিতে জীবন যাপন করার জন্য এই ব্রত পালন করা হয়।

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেঁজুতি ব্রত পালন করার নিয়ম সম্পর্কে:

সেঁজুতি ব্রত পালন করার উপকরণ:

  • দুর্বা ঘাস,
  • মধু পর্কের বাটি,
  • দুধ,
  • দই,
  • ঘি,
  • মধু,
  • চিনি আর চন্দন,
  • একখানি কাপড়,
  • একখানি চাদর,
  • একটি বাটি, আর
  • সাধ্যমত ব্রাহ্মণকে দেওয়ার মতো দক্ষিণা।

শিবের চারিদিকে যে ১৬ ঘর থাকবে:

  • জলভরা ঘট আর
  • ঘাটের পাশে একটি প্রদীপ থাকবে
  • ১৬ ঘর ও শিব,
  • দোলা,
  • কড়া,
  • বেগুন পাতা,
  • সরগাছ,
  • বেনা গাছ,
  • বাঁশের কোড়া,
  • যমুনা,
  • সুপুরি গাছ,
  • চন্দ্র- সূর্য,
  • হাট-ঘাট,
  • গোয়াল,
  • অশ্বত্থ গাছ,
  • বটি,
  • খ্যাংরা।

সেঁজুতির ৫২ ঘর:

শিবের ১৬টি ঘর ছাড়াও আরো যেগুলি আছে, সেগুলি হল:-

শিব মন্দির, লতাপাতা, পাকা পান, নাট মন্দির, তেকোনা প্রদীপ, হাতে ছেলে কাঁখে ছেলে, ঢেঁকি, খাট পালঙ্ক, ধাতা-কাতা, আম-কাঁঠালের পিড়ি, ঘি ও চন্দনের বাটি, গহনা, রান্নাঘর, আয়না, উদ্বেড়ালি, বেড়ি, হাতা, পাখি, কুলগাছ, কাজল লতা, সিঁদুর চুুপড়ি, নক্ষত্র, পানের বাটা, শাঁখ, ময়না, দশ পুতুল, পাখি, ইন্দ্র, তেরাজ, খাট্টা ডুমুর, ধানের মরাই, তালগাছ, থুতু ফেলা, কুঁচ কুঁচতি।

ব্রত উদযাপন:

সেঁজুতি ব্রত উদযাপনের সময় তিন জোড়া কাপড়, তিন জোড়া চাদর আর মধু পর্কের বাটি তিনটি প্রয়োজন পড়বে। তাতে থাকবে দই, মধু, চিনি, দুধ, ঘি আর চন্দন। তিনজন ব্রাহ্মণকে পরিতোষের সঙ্গে ভোজন করাতে হবে আপনার সাধ্যমত। প্রত্যেককে দক্ষিণার সঙ্গে এক এক জোড়া কাপড়, চাদর আর এক একটি মধু পর্কের বাটি দান করতে হবে।

ব্রত অনুষ্ঠান পালন:

সেঁজুতি ব্রত অনুষ্ঠানের জন্য আপনার ঘরের বারান্দা অথবা ছাদে বা ঘরের উঠানে চালের পিটুলির আলপনা দিতে হবে। আলপনায় অনেক কিছু আঁকা যায়, তবে যেমন ধরুন দোলা, শিব, কুঁড়া, পুতুল, ষোল ঘর, গোয়াল, তেকোনা প্রদীপ, বেনাগাছ, ঢেঁকি, রান্নাঘর, গোলা, পাকা পান, কাজল লতা, শাঁখ, পাখি, খাট পালঙ্ক এবং এই রকমের আরো অনেক জিনিসপত্র।

তবে যে কয়টি জিনিস না আঁকলেই নয় সেই কয়টি হল শিব, দুটি পুতুল, কোঁড়া, দোলা এই সমস্ত। মূল যে আলপনাটি হবে সেটি যে রকম হবে সেটি হল ঘট স্থাপন করতে হবে উপরে শিব আর নিচে পুতুলের মাঝখানে চৌকো জায়গাটিতে অর্থাৎ সেঁজুতির কোঁড়ার উপরে।

ঘটের সামনে তেকোনা প্রদীপ জ্বালিয়ে তারপর দুর্বা ঘাস দেওয়ার সাথে সাথে এই মন্ত্র পড়তে হবে:-

“সাঁঝ ভোজন সেঁজুতি, ষোল ঘরের ষোল বতি, তার মধ্যে আমি এক বতি,
বতি হয়ে মাগি (চাই) বর, ধন পুত্রে বাড়ুক বাপ মার ঘর,
(আবার) সাঁঝ ভোজন সেঁজুতি ধন পুত্রে বাড়ুক আমার বরের ঘর।”

এইভাবে সেঁজুতি পূজা হলে এরপর গঙ্গা যমুনার পূজা করতে হবে, গঙ্গা যমুনা আলপনা দিয়ে সেই ঘটটি ধরে মন্ত্র পড়ে দুর্বা ঘাস অর্পণ করতে হবে।

গঙ্গা যমুনা পূজার মন্ত্র:-

“গঙ্গা যমুনা জোড়া হয়ে, সাত ভাইয়ের বোন হয়ে,
সাবিত্রী সমান হয়ে নিশতা নীল বতি, সাত ভাইয়ের বোন পুত্রবতী,
গঙ্গা যমুনা পূজ্যন, সোনার থালে ভূজ্যন,
সোনার থালে ক্ষীরের নাড়ু,
শাঁখের উপর সুবর্ণের খাড়ু।”

এরপর চন্দ্র-সূর্যের করতে হবে পূজা:

“চন্দ্র সূর্য পূজ্যন, সোনার থালে ভূজ্যন,
সোনার থালে ক্ষীরের নাড়ু, শাঁখের উপর সুবর্ণের খাড়ু।”

এরপর হাট-ঘাট, গো গোয়ালের পূজা করতে হবে এই মন্ত্র বলে, অর্থাৎ উপরে যে নিয়মে ছড়া গুলি রয়েছে সেই নিয়মে হাটঘাট ও গোয়ালার মন্ত্রটি পাঠ করতে হবে।

এরপর পূজা সম্পন্ন হয়ে গেলে দুর্বা ঘাস গুলি কুড়াতে কুড়াতে যে মন্ত্র বলতে হবে:-

“অরুণ ঠাকুর বরণে, ফুল ফুটেছে চরণে,
যখন ঠাকুর দেবেন বর,
ফুল কুড়িয়ে যাব ঘর”।

আর এইভাবেই সেঁজুতি ব্রত সমাপ্ত হয়।

সেঁজুতি ব্রত পালন করার তিনটি ধাপ:

সেঁজুতি ব্রত পালন করার তিনটি পর্যায়ে রয়েছে অর্থাৎ আহরণ, ক্রিয়া এবং ছড়া:-

১) প্রথম পর্যায়ে ব্রত পালনের প্রয়োজনীয় উপাচার অথবা উপকরণ যেমন ধরুন একটি কলসি, আতপ চালের তৈরি করা পিটুলি, প্রচুর পরিমাণে দুর্বা ঘাস, কেননা এই ব্রত পালন করতে প্রচুর দুর্বা ঘাস প্রয়োজন পড়ে, ধূপ, প্রদীপ ও একটি জলপূর্ণ ঘট রাখতে হবে।

২) দ্বিতীয় পর্যায়ে কুমারী মেয়েরা মনের কামনা বাস্তবায়নের জন্য পিটুলি দিয়ে তৈরি করা শিবমূর্তি, শিব মন্দির, গাছ-গাছালি, ঘরবাড়ি, গঙ্গা, যমুনা, গৃহকর্তা, রান্নাঘর, তেজসপত্র ও গয়না, দশ পুতুল, হাতে পো কাঁখে পো (হাতে ছেলে কাঁখে ছেলে) প্রভৃতি ৫২ টি বিষয়ের রেখা চিত্রে আলপনা আঁকতে হবে।

৩) এরপর তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিটি রেখাচিত্রের উপর একটি করে দুর্বাঘাস দিয়ে মনস্কামনা পূরণের জন্য ৫২ টি ছড়া আবৃত্তি করে পূজা করতে হয়।

৪) এরপর ব্রত শেষ করার পর দুর্বা ঘাস গুলি আঙ্গিনা থেকে তুলে কলসিতে রেখে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করতে হবে।

নিয়ম অনুসারে জানা যায় চার বছর একটানা এই ব্রত পালন করতে হয়, চার বছর নিয়মমাফিক ব্রত পালনের পর তিনজন ব্রাহ্মণকে ভোজন সহযোগে কাপড়, পঞ্চামৃত, চাদর, মধু পর্কের বাটি ও দক্ষিণা দানসহ এই ব্রত টি উদযাপন ও সম্পন্ন করতে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!