অম্বিকা মাতার পূজা (Ambika Mata Puja): বিভিন্ন পূজা অর্চনার মধ্যে অম্বিকা মাতার পূজা কিন্তু বিশেষভাবে প্রচলিত। রাজ্যের প্রাচীন কালী মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম হলো এই অম্বিকা কালনার মন্দির। তবে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতামত এবং ইতিহাসবিদদের মত অনুসারে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা চিত্র সেন রায় দেবী কালনার মন্দিরের সংস্কার করেন।
জোড়া বাংলোর ধাঁচে তৈরি করা হয় মন্দিরটি, উঁচু ভীতের উপরে তৈরি করা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, মন্দিরের বাইরের অংশে পোড়া মাটির কাজ রয়েছে। মন্দির চত্বরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত পাঁচটি শিব মন্দির, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন যোগী অন্মু ঋষি এবং বিগ্রহের পাদতলে শায়িত রয়েছে শিব আর দেবীর বাম হাতে রয়েছে খড়গ ও নরমুন্ড।
সারা বছর ধরে চলে দেবী অম্বিকার পূজা (Ambika Puja) অর্চনা। তবে কালীপূজার দিন হয় বিশেষ পূজা পাট। সেই পূজায় আবার বিশেষ কিছু নিয়ম ও পালন করা হয়ে থাকে। যেমন ধরুন পুজোর সময় পুরোহিত ছাড়া মন্দিরে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না, পুজো করেন শুধুমাত্র পুরোহিতরাই। সকালে শুরু হয় এই পূজা অর্চনা এবং দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকে। বিকেলে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের মূল দরজা, রাতে দেবীকে অন্ন ভোগ দেওয়া হয়।
অম্বিকা মাতার পূজা সব জায়গায় প্রচলিত না থাকলেও শ্রীপাঠ অম্বিকা কালনা গঞ্জের অতি প্রাচীন মা মহিষমর্দিনীর বাৎসরিক মহাপূজার বিশেষ আয়োজন হয় প্রতিবছর। যা প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো। এক সময় এই পুজো ছিল রানাঘাটে পাল চৌধুরীর বাড়িতে। কালের নিয়মে পরিবর্তন হতে হতে এই চলে আসে অম্বিকা কালনায়। প্রথম দিকে এই মহা পূজা হতো চৈত্র মাসে হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া মন্ডপে। কিন্তু সেই সময়ের চৈত্র মাসে ঝড় বৃষ্টির প্রকোপ ছিল প্রচুর এবং নানা কারণে কালবৈশাখীর সম্ভাবনা থাকতো, কাশি থেকে ব্রাহ্মণদের এনে এই পুজোর তিথি ঠিক করা হয় শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে।
দুর্গাপূজার মতো করে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের পূজা হয় খুবই আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে। তার সাথে সাথে রক্তদান, বস্ত্র দান, নর-নারায়ণের সেবা হয় প্রায় চার দিন ধরে। এছাড়া সমস্ত নিয়ম মেনে আজও পর্যন্ত নহবতে বাজানো হয় সানাই। মন্দির চত্বরে প্রতিদিন প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। আপনারাও কিন্তু এই পূজায় অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং এখানকার আশেপাশের কালনা নগরের মন্দির দর্শন করার জন্য খুবই প্রসিদ্ধ।
অম্বিকা মাতার পৌরাণিক কাহিনী:
যেহেতু আমরা আগেই জেনেছি যে এই পূজা প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো। আজ থেকে ৩০০ বছর আগেও গভীর জঙ্গলে ভরা ছিল আজকের হাওড়া কাটোয়া রেলপথে পূর্ব বর্ধমান জেলার এই মহকুমা শহর কালনা। একদিন বর্ধমানের মহারাজা চিত্র সেন রায় ভাগিরথী তীরস্থ জঙ্গল পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন ঘোড়ার উপরে চেপে।
হঠাৎ কানে এলো ঘণ্টা ও ঢাকের বাদ্যি, উলুধ্বনি রাজা তা লক্ষ্য করে ঢুকে পড়লেন জঙ্গলের আরো আরো গভীরে। দেখলেন জনমানবহীন একটি প্রাচীন ভাঙ্গা মন্দির এবং সর্বগৃহে ভীষণ মূর্তি দেবী কালিকা, সঙ্গে সাজানো রয়েছে পূজার বিভিন্ন রকমের উপকরণ ও নৈবেদ্য।
এই সব কিছু দেখে রাজা তবুও হতভম্ব হয়ে যান। তারপর ফিরে এলেন বর্ধমানের প্রাসাদে। ১৭৩৯ সালে প্রাচীন এই মন্দির ক্ষেত্রে নতুন মন্দির নির্মাণ করে দেবী অম্বিকার নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন মহারাজা চিত্র সেন রায়।
মাতা অম্বিকার মন্দির প্রতিষ্ঠা:
এই মন্দিরটি বেশ উঁচু বেদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এত উঁচু বেদী দেখে অনেকের ধারণা হতেই পারে যে প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ভিতরের উপরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমান যে মন্দিরটি এখন রয়েছে তবে কালনা শহরের পূর্বপ্রান্তে ভাগীরথী নদীর কাছেই এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরীর অবস্থান বলে সকলেই জানেন।
মন্দিরের বাইরের গায়ে এখনো পর্যন্ত লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে অটুট পোড়ামাটি দিয়ে কারুকার্য করা। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে তারপরে উঠতে হয় গর্ভ মন্দির এর ভিতরে। বাংলার দোতালা ঘরের ধাঁচে তৈরি করা হয়েছে মন্দির যা জোড়া বাংলোর মতো দেখতে লাগে। মূল যে মন্দিরটি রয়েছে তার পাশেই রয়েছে পরপর তিনটি শিব মন্দির। এছাড়া পোড়ামাটির কাজের সাথে সুন্দরভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে শিলালিপির কথা।
মাতা অম্বিকার পূজা:
প্রতিবছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় এই সিদ্ধেশ্বরীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, শিবরাত্রি ব্রত, দুর্গাপূজার চারদিন, সপ্তাহে যেকোনো শনিবার অথবা মঙ্গলবার এবং যে কোন অমাবস্যায় তিল ধারনের জায়গা থাকে না এই মন্দির প্রাঙ্গনে।
এছাড়া দেবীর প্রতিদিনের নৈবেদ্য তে অন্ন ভোগের আয়োজন থাকে। তার সাথে সাথে আমিষ বা মাছ ভোগ দেওয়াটাও এই পূজার নিয়মের মধ্যেই পড়ে। এছাড়া, বাৎসরিক পুজাতে চিংড়ি ও ইলিশ মাছের ভোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এখানে প্রাচীন প্রথা পশু বলি অর্থাৎ বলিপ্রথাও প্রচলিত রয়েছে।